ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ,ব্রেস্ট ক্যান্সার হলে কী করণীয়,ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা (Brest Cancerer Lakhhan,Brest Cancer Keno Hoy)

আজকের ট্রপিকে আমরা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ব্রেস্ট ক্যান্সার (Brest Cancer), নিয়ে আলোচনা করব। বর্তমান যুগে নারীদের শরীরের সময়ে অসময়ে আগাছার মত গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন অসুখ বিসুখের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার হল একটি অন্যতম মহাগুরুত্বপূর্ণ অসুখ।

ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সার হল এক দুরারোগ্য ব্যাধি যা শুরুর দিকে ধরা পড়লে তার চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে এই রোগ নির্ণয় করা বা রোগীর শরীরে এই রোগ দানা বেঁধেছে কিনা তা বোঝার জন্যে আমাদের বেশি বেশি করে ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়টি নিয়ে নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ বা ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো কী ? অথাৎ কি কারণে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয় ? কিভাবে ব্রেস্ট ক্যান্সার এড়ানো যায় এই সমস্ত বিষয়ে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কাযক্রম করে মানুষের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগটি নিয়ে সজাগ অভিযান কর্মসূচী চালালে

অনেকাংশেই মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিষয়ে আরো বেশি সজাগ হবে। এর ফলে মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়টিকে হেলায় না ফেলে দিয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার হলে কী করণীয় ? ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ ও চিকিৎসা কিভাবে সম্ভব এই বিষয়ে নিজেরাই আগে ভাগে সতর্ক হবে।

ব্রেস্ট ক্যান্সার কী (What is breast cancer)

এক কথায় বলতে গেলে মানবদেহে কোষের অনিয়মিত বৃদ্ধি হল ক্যান্সার (Cancer)। জীবদেহে কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণকারী জিনের মধ্যে যখন মিউটেশন নামক বিশেষ পরিবর্তন ঘটে তখন সেই জীব কোষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।

এই জীব কোষ গুলো সাধারণ জীব কোষের তুলনায় খুব দ্রুত এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায়। এখানে সবথেকে মজার ব্যাপার হল ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ সুস্থ সবল কোষের জন্ম না দিয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ গুলো তাদের মতই পুনঃরায় নতুন ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের জন্ম দেয়।

সেরকমই ব্রেস্ট ক্যান্সার হল এমন এক ধরনের ক্যান্সার যা স্তনের কোষে বাসা বাঁধে এবং স্তনের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অংশে যেমন- টিউব, লোবিউল গ্রন্থি এবং নালী এইসমস্ত জায়গায় ক্রমাগত বংশ বিস্তার করতে থাকে।

তবে ব্রেস্ট ক্যান্সার পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যেই সর্বাপেক্ষা বেশি হতে দেখা যায়। তাই ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যানসারকে নারীদের কাছে একটি আতঙ্ক বললে কিছু ভুল বলা হবেনা। গবেষণায় দেখা গেছে পুরুষের চেয়ে নারীদের স্তন ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই বেশি থাকে।

কারণ হিসাবে দেখা গেছে নারীরা নিজেদের গোপন অঙ্গের রোগগুলোর ব্যাপারে কারো সঙ্গে সহজে শেয়ার করতে বা বলতে চায়না। ফলে সচেতনতার অভাবে অনেক নারী তার শরীরে নিজের অজান্তেই এতবড় ভয়ানক একটা মরণ ব্যাধি বাঁসা বাঁধছে সেটা বুঝে উঠতেই পারেনা।

নারীদের স্তন তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে তৈরী – লবিউল, নালী এবং স্তন বৃন্তের সঙ্গে লবিউল ও নালীর সঙ্গে সংযোগকারী টিস্যু। লবিউল গ্রন্থি দুধ উৎপাদন করে এবং নালী গুলি লবিউল গ্রন্থি থেকে স্তন বৃন্ত পর্যন্ত দুধ পরিবহন করে।

এই নালী অথাৎ টিউব গুলো আঁশযুক্ত এবং চর্বিযুক্ত টিসু দিয়ে তৈরী হয়। নারীদেহে সবথেকে বেশি ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে এই লবিউল গ্রন্থির মধ্যে। এখান থেকেই স্তনের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সার ছড়িয়ে পরে।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ
ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ

স্তনের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের এই বিশেষ অবস্থাকে মেটাস্টেসাইজড (Metastasis) বলা হয়। মেটাস্টেসাইজড এর মাধ্যমে স্তনের ভেতরে মাংসপিন্ডের মত গুটলি বা পিন্ড (Tumor) তৈরী হয়।

এই মেটাস্টেসাইজড স্তনের কোষের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পরে ক্যান্সারের আকার দেয়। নারীদের শরীরে মেটাস্টেসাইজড (Metastasis) অথাৎ গুটলি বা পিন্ডকেই স্তন ক্যান্সার (Tumor) বা ব্রেস্ট ক্যান্সার (Breast Cancer) বলা হয়।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ (Brest Cancerer Lokhoon)

ব্রেস্ট ক্যানসারের লক্ষণ অথাৎ কী করে বুঝবেন আপনি ব্রেস্ট ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছেন কিনা ! আসুন তাহলে দেখে নেওয়া যাক ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো কী কী ? কী করে ব্রেস্ট ক্যান্সার সনাক্ত করবেন –

০১. প্রত্যেক মেয়েদের স্নান করার সময় নিজের স্তন ভালো ভাবে, হাতের চেটোয় বা আঙুলের সাহায্যে চাপ দিয়ে স্তনের আশেপাশের টিস্যুতে গুলো টিপে টিপে কোনো মাংস পিন্ড দানা বাঁধছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

স্তনে চাপ দিয়ে পরীক্ষা করার সময় স্তনের চারপাশে যেমন -বগল, কলারবোন ইত্যাদি জায়গায় কোনো পিন্ড তৈরী হলে তা ব্রেস্ট ক্যান্সারের (Brest Cancer ) লক্ষণ হতে পারে।

০২. নারীদের হঠাৎ করে স্তনের আকার পরিবর্তন হয়ে যাওয়া অথাৎ স্তন আকারে বৃদ্ধি পাওয়া ব্রেস্ট ক্যান্সারের (Breast Cancer) লক্ষণ হতে পারে।

০৩. নারীদের স্তন ফুলে উঠে প্যাঁচানো লাল ভাব দেখা দেওয়া এবং স্পর্শ করলে বা আলতো করে ছুঁয়ে দেখলে অত্যন্ত কোমল মনে হওয়া নারী শরীরে ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

০৪. নারীদের স্তনে র‍্যাশহীন চুলকানি হওয়া ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

ব্রেস্ট-ক্যান্সারের-কারণ
ব্রেস্ট-ক্যান্সারের-কারণ

০৫. নারীদের শরীরে হঠাৎ করে যদি স্তন বৃন্তের পরিবর্তন হয় অথাৎ নারী যদি শিশুকে স্তন্যপান না করান, তবুও যদি সেই নারীর স্তনের স্তনবৃন্ত চ্যাপ্টা, খাড়া , উল্টানো অথাৎ অসম আকারে পরিবর্তন হয় তাহলে সেটা স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

০৬. স্তনের টিস্যুতে ডিম্পল দেখা দেওয়া অথাৎ স্তনের উপরের ত্বক লাল ডিম্পল যুক্ত হয়ে যাওয়া অথবা স্তনের চামড়ায় কমলালেবুর খোসার মত ছোট ছোট ছিদ্র দেখা দেওয়া সেটাও কিন্ত স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

০৭. ব্রেস্ট ক্যান্সার সাধারণত দুগ্ধনালীতে বেশী করে দেখতে পাওয়া যায়। তাই স্তনবৃন্ত থেকে জলযুক্ত ডিসচার্জ বা দুধযুক্ত রক্তের মত ডিসচার্জ দেখা দিলে সেটা স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

০৮. স্তনবৃন্তে চাকা চাকা দাগ লক্ষ করা গেলে সেটা ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণ হতে পারে।

০৯. স্তনবৃন্তের বোঁটার পরিবর্তন হয়ে স্তন বৃন্তের বোঁটা ভেতর দিকে ঢুকে গেলে অথাৎ চুপসে কিংবা বসে গেলে তা ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণ হতে পারে।

১০. প্রায়শই নারীদের ঘাড়-গর্দান, কাঁধ শক্ত হয়ে যাওয়া অথবা মেরুদন্ড ও কাঁধে ব্যাথা অনুভব হলে সেটাও ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। তাই উপরিউক্ত যে কোনো একটি লক্ষণ দেখতে পেলে অবশ্যই ডাক্তারবাবুদের সাথে পরামর্শ করা উচিত।

ক্যান্সার শনাক্তকরণ পরীক্ষা :-

এই ধরণের লক্ষণ গুলো দেখে ডাক্তারবাবুরা রোগীর শরীরের রোগীর রোগের History sheet নিয়ে রোগীর বয়সের সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে ডাক্তারবাবুরা ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্যে – আলট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই, ম্যামোগ্রাফি, বায়োপসি/মাংস পরীক্ষা, ইত্যাদি পরীক্ষা গুলো করে থাকেন।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ (Causes of Brest Cancer)

উপরের অনুচ্ছেদে আমরা ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো নিয়ে কথা বললাম, এবারে আমরা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ অথাৎ ব্রেস্ট ক্যান্সার কেন হয় সেই ব্যাপারে আলোচনা করব।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণায় এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে ক্যান্সার কেন হয় বা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ কী ? এই ব্যাপারে সু-নির্দিষ্ট কোন কারণ জানা না গেলেও গবেষণায় ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার পিছনে বা ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনার পিছনে কয়েকটি কারণ অনুধাবন করা গেছে –

স্তন ক্যান্সার কেন হয় তার পরিবর্তন যোগ্য কিছু কারণসমূহ

০১. বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা সময়ের সাথে ঘরোয়া বাড়ির খাবার ছেড়ে বাইরের খাবারে মেতে উঠেছে। খাদ্যতালিকায় শাক সবজি না রেখে অতিরিক্ত পরিমানে বাইরের ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া দাওয়া করে ।

এছাড়া কেমিক্যাল মিশ্রিত টিনের কেনে স্টোরেজ করা খাবার খাওয়া, কৃত্তিম মিষ্টি ও রঙ মেশানো ভেজাল খাবার খাওয়া নারী ও পুরুষ উভয়ের স্তন ক্যান্সার হওয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।

০২. সময়মত বিয়ে না করে অনেক বেশি বয়স করে বিয়ে করা এবং বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে সময়মত সন্তান না নিয়ে অনেক বেশি বয়সে বিশেষ করে, ৩০ বছরের পরে সন্তান নেওয়া মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়।

০৩. আজকালকার মায়েদের মধ্যে ক্রমাগত ধারণা চলে এসেছে মায়ের স্তনের দুধ বাচ্চাদের খাওয়ালে স্তন নাকি ঝুলে যায়, তাই আজকালকার মেয়েরা সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়াতে চাননা।

কিন্ত আপনি কি জানেন সন্তানকে নিয়মিত বুকের দুধ (Breastfeeding) না খাওয়ানোর অভ্যাসের কারণে স্তন ক্যান্সারে (Brest Cancer) আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা ক্রমশঃ বেড়ে যায়।

০৪. আজকালকার যুগে কি নারী, কি পুরুষ, সবাই ঘামে বগলের দুগন্ধ দূর করার উপায় হিসাবে বিভিন্ন ধরণের বডি স্প্রে বা ডিউ ব্যবহার করে। কিন্ত অনেক সময় আমরা কোম্পানির ঠিকঠাক লেবেল না দেখেই ডিওডোরেন্ট কিনে ফেলি।

তবে আমাদের সবারই ডিওডোরেন্ট কেনার সময় ডিওডোরেন্ট এর মধ্যে কি কি উপাদান মেশানো আছে সেই বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত। তবে ডিওডোরেন্ট এর মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় দ্রব্য মেশানো থাকলে তা ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

ডিওডোরেন্ট যেহেতু আমরা দৈনন্দিন সুগন্ধি হিসাবে ব্যবহার করি, তাই আমাদের সবারই কোন কোম্পানীর ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করব সেটা একজন ভালো স্কিন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে তবেই কেনা উচিত।

০৫. মেয়ে হোক বা ছেলে, উভয়েরই ক্ষেত্রে পরিশ্রম না করে দিন প্রতিদিন ওজন বেড়ে গেলে সেটাও ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।

০৬. নারীদের ভুল সাইজের অন্তর্বাস (Bresiar/Bra) নির্ণয় করা অথাৎ স্তনের আকার অনুযায়ী সঠিক মাপের অন্তর্বাস (Bresiar/Bra) না পড়ার জন্যেও নারীদের স্তনে ক্যান্সার হতে পারে। স্তনের আকারের চেয়ে বেশি বড় মাপের অন্তর্বাস (Bresiar/Bra) পড়লে স্তনের টিস্যুগুলো ঠিকঠাক সাপোর্ট পায়না।

আবার স্তনের আকারের তুলনায় অতিরিক্ত ছোট বা টাইট অন্তর্বাস (Bresiar/Bra) পড়লে স্তনের ভেতরের তরলবাহী লসিকাগুলোকে মাড়িয়ে ফেলতে পারে বা কেটে ফেলতে পারে, যা আগে গিয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।

০৭. তবে এটাও ঠিক, সবসময় মেয়েদের অন্তর্বাস (Bresiar/Bra) পরে থাকা উচিত নয়। কারণ সারাক্ষন অন্তর্বাস পড়ে থাকলে শরীর থেকে যা ঘাম নির্গত হয় তা অন্তর্বাসের মধ্যে জমে থাকে এবং হাওয়া বাতাসের ঠিকঠাক ভেন্ডিলেশন না হওয়ায় অন্তর্বাসের মধ্যে আদ্রতা জমে থাকে।

অন্তর্বাসের মধ্যে জমে থাকা আদ্রতায় আগে গিয়ে মেয়েদের স্তন ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই অন্তত বাড়ীতে থাকার সময় অন্তত রাতটুকুতে অন্তর্বাস (Bresiar/Bra) না পড়ে খোলামেলা পোশাক পড়ে ঘুমোনো উচিত।

০৮. আমরা অনেকেই বাড়ীতে সুগন্ধি হিসাবে বা পোঁকামাকড় ও কীটপতঙ্গ এড়াতে বাড়ীতে এয়ার ফ্রেসনার (Air freshner), কীটনাশক, কেমিক্যাল কসমেটিক্স, ন্যাপথালিন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করি এই সমস্ত উগ্র সুগন্ধি গুলো অনেক সময় ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

স্তন ক্যান্সার কেন হয় তার অপরিপবর্তনযোগ্য কিছু কারণসমূহ

নারীদের স্তনের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হল ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে বেশ কতগুলো কারণ আছে যে সমস্ত কারণ গুলো নারীদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় –

০১. দিন বদলাচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ তার খাদ্যাভ্যাস পাল্টাচ্ছে বাড়ির খাবার ছেড়ে দিয়ে বাইরের জাঙ্ক ফুডের মত খাবারে মানুষের আসক্তি বেড়েছে। মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় বাড়ীর নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস পাল্টানোটাও ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।

গবেষণাতে এটিও দেখা গেছে পরিবারের বংশগত কারণ অথাৎ জিনেটিক কারণেও পরিবারে বংশগত ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে তার প্রভাবেও পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা থাকে। BRC A-01, BRC A-02 জিনের মিউটেশন ০৫%- ১০% স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ী থাকে।

০২. মহিলাদের মাসিক শুরু হওয়া এবং বন্ধ হওয়ার উপরেও ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। যদি কোনো নারীর ১২ বছর বয়স হওয়ার আগে ঋতুস্রাব হয় এবং দেরিতে মানে ৫০ বছরের পরে মেনোপজ বা ঋতু বন্ধ হয়, সেই সমস্ত মহিলাদেরও ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

০৩. যারা দীর্ঘ্যদিন ধরে সন্তান নিয়ন্ত্রণে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি খান বা হরমোনের ইঞ্জেকশন নেন তাদেরও ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার একরকম ঝুঁকি থাকে। তাই সন্তান ও পরিবার নিয়ন্ত্রণে এই সমস্ত গর্ভনিরোধক ওষুধ না খাওয়ায় ভাল।

০৪. সভ্য সমাজের নামে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে তামাক জাতীয় দ্রব্য, গুটখা, সুপারী, ধূম্ৰপান ও অ্যালকোহল সেবনের ফলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। তাই এই সমস্ত নেশাজাত দ্রব্য এড়িয়ে যাওয়াটাই সবারই স্বাস্থ্যের জন্যেই ভাল।

০৫. মানুষের লিঙ্গভেদে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। যেমন – তুলনামূলকভাবে পুরুষের তুলনায় নারীদের ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই বেশি থাকে।

ব্রেস্ট-ক্যান্সারের-কারণ
ব্রেস্ট-ক্যান্সারের-কারণ

০৬. ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া না হওয়ার পিছনে বয়স হল খুব বড় একটা ফ্যাক্টর। বিশেষ করে ৫৫ বছর বয়সের উর্দ্ধ বয়সী মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারে (Breast Cancer) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

০৭. চিকিৎসাকার্যে শরীরে রেডিয়েশন এক্সপোজারের ব্যবহার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ধরুন আপনি মাথা, ঘাড়, গলা, বুক, পেট ইত্যাদি জায়গায় রেডিয়েশন থেরাপি নিয়ে থাকেন তাহলে আপনারও হয়ত আগে গিয়ে ক্যান্সার দেখা দিতে পারে।

০৮. হরমোন পরিবর্তন – অনেক মহিলা আছেন যারা মাসিক বন্ধ হওয়ার পর কৃত্রিম প্রণালীতে দীর্ঘ্যদিন ধরে অনেক বেশি পরিমানে এস্ট্রোজেন হরমোন নিয়ে থাকেন অথাৎ হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি গ্রহণ করেন। এই সমস্ত মহিলাদের কিন্ত স্তন ক্যান্সার ঝুঁকি কিন্ত বেশি থাকে।

ব্রেস্ট ক্যান্সার কত রকমের হয় (স্তন ক্যান্সার কত রকমের)

স্তন ক্যান্সার বা ব্রেস্ট ক্যান্সারের যদি প্রকারভেদ করা যায় তাহলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ধরণ অনুযায়ী ব্রেস্ট ক্যানসারকে প্রধানত চারভাগে ভাগ করা হয়েছে –

০১. ডাক্টাল কার্সিনোমা ইন সিটু (নন-ইনভেসিভ) /Ductal carcinoma in situ (non-invasive)- ব্রেস্ট ক্যান্সারের এই পর্যায়ে ক্যান্সার শুধু স্তনের নালীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে স্তনের আশেপাশের টিস্যু গুলোকে সংক্রামিত করেনা।

০২. লোবুলার কার্সিনোমা ইন সিটু (Lobular carcinoma in situ)- ব্রেস্ট ক্যান্সারের এই পর্যায়ে ক্যান্সার শুধু দুগ্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থির মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকে, তার আশেপাশের গ্রন্থিগুলোকে সংক্রামিত করেনা।

০৩. ইনভেসিভ ডাক্টাল কার্সিনোমা (Invasive ductal carcinoma (IDC)- ব্রেস্ট ক্যান্সারের এই পর্যায়টি স্তনের দুগ্ধ নালীতে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে স্তনের কাছাকাছি আরো অন্যান্য টিস্যু গুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পরে।

০৪. ইনভেসিভ লোবুলার কার্সিনোমা (Invasive lobular carcinoma) – এই ধরণের ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রথমে স্তনের লোবিউলে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় তারপর আশেপাশের টিস্যুগুলোর মধ্যে ছড়ায়।

নোট :- উপরিউক্ত ক্যান্সার গুলো ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি সাধারণ ব্রেস্ট ক্যান্সার চোখে পড়ে। এই সমস্ত সাধারণ ব্রেস্ট ক্যান্সার গুলো হল – স্তনবৃন্তের প্যাগেট রোগ, ফাইলোডস টিউমার , এনজিওসারকোমা, প্রদাহজনক স্তন ক্যান্সার, ট্রিপল-নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার ইত্যাদি।

ব্রেস্ট ক্যানসারের চিকিৎসা বা ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ

ডাক্তারবাবুরা ক্যান্সারের ধরণ অথাৎ ক্যান্সারের স্টেজ অনুযায়ী ব্রেস্ট ক্যান্সারের ধরণ নির্ধারণ করেন। তবে সচরাচর যেটা দেখা যায় তা হল শুরুর দিকে অথাৎ প্রাথমিক স্টেজে ক্যান্সার ধরা পড়লে ৯০-৯৫% ক্যান্সার আক্রান্ত রুগী ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভবনায় বেশি থাকে।

তবে ক্যান্সারের পর্যায় অথাৎ ক্যান্সারের ধরণ অনুযায়ী ক্যান্সার চিকিৎসা প্রণালীকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- কেমোথেরাপি, ব্রেস্ট ক্যান্সার সার্জারি, রেডিওথেরাপি, হরমোন থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি ইত্যাদি।

০১. কেমোথেরাপি

সবধরণের ক্যান্সারের চিকিৎসাতে প্রাথমিকভাবে ডাক্তারবাবুরা কেমোথেরাপির ব্যবহার করে। কারণ কেমোথেরাপি এমন একটি চিকিৎসা প্রণালী যেটা রোগীর দেহের বিভিন্ন জায়গায় ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লেও কেমোথেরাপি ব্যবহার করে ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব।

তবে এখানে একটা কথা না বললে নয়, কেমোথেরাপি নিলে কেমোথেরাপি দ্বারা রোগীর দেহে ক্যান্সার নিরাময় হয় ঠিকই তবে কেমোথেরাপির বেশ কতগুলো পার্শ্বপতিক্রিয়া আছে ঠিকই, তবে এটাও ঠিক ক্যান্সার রোধে কেমোথেরাপির কোনো বিকল্প নেই।

০২. সার্জারি-

ব্রেস্ট ক্যান্সার বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলে ডাক্তারবাবু ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা মিলে সার্জারি (surgery) করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক সময় ডাক্তারবাবুরা টিউমার কেটে ফেলে সার্জারি করে ক্যান্সারের চিকিৎসা করেন । আবার কখনো কখনো প্রয়োজনে ডাক্তারবাবুরা ক্যান্সার রিমুভ করার জন্যে পুরো স্তন কেটে ফেলে দেন।

০৩. রেডিওথেরাপি-

আরো অন্যান্য চিকিৎসার তুলনায় ক্যান্সার নির্মূলে রেডিওথেরাপির পার্শ্বপতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তাই ক্যান্সারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপির পর রেডিওথেরাপির ব্যবহার হয়।

মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে যেমন- স্তনে, হাড়ে, বুক, পিঠ সর্বত্র ক্যান্সার নির্মূলে রেডিওথেরাপির ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে হাড়ের ফ্যাকচার রোধে রেডিওথেরাপির ব্যবহার করা হচ্ছে।

০৪. হরমোন থেরাপি

সব ক্যান্সারের চিকিৎসায় হরমোন থেরাপি ব্যবহার করা হয়না। ডাক্তারবাবু এবং ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ঠিক করেন কোন রোগীর ক্যান্সারের চিকিৎসায় হরমোন থেরাপি প্রয়োজন।

০৫. টার্গেটেড থেরাপি

বর্তমান যুগে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিস্কারের মধ্যে টার্গেটেড থেরাপি প্রয়োগ ক্যান্সার চিকিৎসায় এক অভিনব উদ্যোগ। এই ধরণের চিকিৎসা গুলো হল, যেমন – Transtyuumab, Lapatinib, Bevacizumab ইত্যাদি।

ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে কী করণীয়

ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সবার আগে মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরী করতে হবে। কারণ যতদিন পর্যন্ত মানুষ সচেতন না হবে ততদিন ক্যান্সার প্রতিরোধ বা ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়ানো কোনোটাই সম্ভব নয়।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ক্যান্সার প্রতিরোধের বিভিন্ন পন্থা এসেগেছে ঠিকই , তবে ক্যান্সার প্রতিরোধে বা ক্যান্সার নির্ণয়ে Breast Cancer Screening খুব জরুরি। তাই ক্যান্সার প্রতিরোধে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী জনসম্মুখে

বিভিন্ন Cancer program করে মানুষের মধ্যে Cancer বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা উচিত। তবেই রোগী তার সচেতনতাকে কাজে লাগিয়ে রোগী নিজেই সজাগ হয়ে শরীরে প্রাথমিক স্তরেই ক্যান্সার ধরা পড়তে সক্ষম হবে।

ডাক্তারবাবুরাও সময়মত রোগীর রোগ নির্ণয় করে ক্যান্সার নিরাময়ে ব্রতী হতে পারবেন। এইভাবেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মানুষের জীবনশৈলী পরিবর্তন হলে ক্যান্সার রোগের প্রকোপ অনেকাংশেই কমে যাবে।

পরিশিষ্ট

স্তন ক্যান্সার কেন হয় বা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ, ব্রেস্ট ক্যান্সার কী, ব্রেস্ট ক্যান্সার কেন হয়, ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার হলে কী করণীয়, সবকিছুই আমরা সময় সাপেক্ষে কয়েকটি পঙতির মাধ্যমে আপনাদের সামনে তুলো ধরার চেষ্টা করলাম।

তবে শুধু আর্টিকেলের কয়েকটি পঙতিতে বা লাইনে ব্রেস্ট ক্যান্সার কেন হয় বা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ কোনোটাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তবুও আপনাদের সুবিদার্থে ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ ও চিকিৎসা এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে কি করণীয় সম্ভাব্য আলোচনা করা হল।

তবুও আপনাদের মনে ব্রেস্ট ক্যান্সার কেন হয় বা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ ইত্যাদি নিয়ে কোনো ধরণের জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট করে জানাবেন। আমরা যতদ্রুত সম্ভব আপনাদের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

5/5 - (2 votes)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here