গুরু পূর্ণিমা কি, গুরু পূর্ণিমা কেন পালন করা হয় (Guru Purnima Ki, Guru Purnima Keno Palon Kora Hoy)

গুরু পূর্ণিমা কি (Guru Purnima Ki) ? এই প্রশ্নের সহজ সরল উত্তর হল- গুরু পূর্ণিমা হল হিন্দু ধর্মের একটি অতি প্রাচীন প্ৰথা বা গুরু পূজনের বিশেষ এক দিন। যেই দিনটিতে মূলত, শিষ্যরা তার গুরুদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার লক্ষার্থে

বিশেষ দিন হিসাবে চিহ্নিত করে ঐ নির্দিষ্ট দিনে তাদের নিজ নিজ গুরুর পূজন করে। হিন্দু তথা সনাতন ধর্মে গুরু পূর্ণিমার মাহাত্ম্য অপরিসীম। গুরু পূর্ণিমার ইতিহাস উল্টে দেখলে দেখতে পাওয়া যায় প্রত্যেক বছর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে গুরু পূর্ণিমা উদযাপন করা হয়।

গুরু পূজনের এই বিশেষ দিনটিকেই গুরু পূর্ণিমা বলে সম্বোধন করা হয়। আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে গুরু পূর্ণিমা কি ? গুরু পূর্ণিমা কেন পালন করা হয় ? এবং গুরু পূর্ণিমার ইতিহাস ও গুরু পূর্ণিমার তাৎপর্য কি ? এই সমস্ত বিষয় গুলো আলোচনা স্বাপেক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

ইতিহাসের পাতায় গুরু পূর্ণিমা অথাৎ গুরু পূজনের এই প্রথা অতি প্রাচীন। গুরু পূর্ণিমা উদযাপন আজকে শুধু আমাদের দেশ ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবন্ধ নয়। ভারতবর্ষ ছাড়াও আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, ভুটান, মায়ানমার, নেপাল ইত্যাদি দেশে সমাদরে গুরু পূর্ণিমা উদযাপন করা হয়।

হিন্দু ধর্মালম্বী মানুষ জন ছাড়াও বৌদ্ধ এবং শিখ ধর্মের মানুষদের মধ্যে গুরু পূর্ণিমার প্রচলন লক্ষ করা যায়। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় অন্য কোন সম্পর্ক ততটা গুরুত্ব না পেলেও, শুধুমাত্র গুরুকে শ্রদ্ধা জানাতে বৈদিক যুগে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে গুরুদেবের শ্রদ্ধার্থে গুরু পূর্ণিমা উদযাপন করা হত।

ভারতীয় সংস্কৃতির এই প্রাচীন প্রথা থেকেই বোঝা যায় প্রাচীনকালে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষক অথাৎ গুরুর স্থান কতটা উপরে ছিল যে, শুধু মাত্র গুরুকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে শিষ্যরা-ছাত্রসমাজ, গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে সম্মানিত করার জন্য একটি পুরো দিন উৎসর্গ করে গুরুবন্দনা করত।

গুরু পূর্ণিমা কি (Guru Purnima Ki)

গুরুদেব অথাৎ গুরু হল আমাদের সমাজ গড়ার অন্যতম কারিগর। হিন্দু শাস্ত্রে গুরুকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় “গূ” শব্দের অর্থ হল অন্ধকার এবং “গুরু” শব্দের অর্থ হল যিনি অন্ধকার দূর করেন।

এই জগৎ সংসারে গুরুই একজন ব্যক্তি যিনি আমাদের মনের সন্দেহ, জিজ্ঞাসা, অন্ধকার আদি দূর করে আমাদের জীবন চালনে নতুন পথ দেখান। ” তমসা থেকে জ্যোতির্ময়ের পথে পরিচালন করেন।

তাই সমাজ তথা জগৎ সংসারের সকল গুরুকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার লক্ষে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে গুরুদেবের শ্রদ্ধার্থে আয়োজিত গুরু পূজনের বিশেষ দিনটিকে গুরু পূর্ণিমা বলা হয়।

গুরু পূর্ণিমা কি
গুরু পূর্ণিমা কি

প্রতি বছর হিন্দু পঞ্জিকার আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে গুরু পূর্ণিমা অনুষ্ঠিত হয়। এই দিন ছাত্ররা গুরু পূর্ণিমার শুভ লগ্নে গুরুদের শ্রদ্ধা-ভক্তি,শুভেচ্ছা ও প্রণাম নিবেদন করে গুরুদের কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করেন তাই একজন শিষ্য এবং গুরুর কাছে গুরু পূর্ণিমার মাহাত্ম্য অসীম।

আরো পড়ুন : শিক্ষক দিবস কেন পালন করা হয়।

গুরু পূর্ণিমা কেন পালন করা হয় (Guru Purnima Keno Palon Kora Hoy)

গুরু পূর্ণিমা কি এবং গুরু পূর্ণিমা কেন পালন করা হয় ? এই নিয়ে হিন্দু ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মে গুরু পূর্ণিমার ইতিহাস খুঁজে দেখলে বেশ কিছু যৌক্তিকতা দেখতে পাওয়া যায়। তাই হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয়ধর্মেই গুরু পূর্ণিমার দিনটি বিশেষ রুপে গুরু পূজনের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত বিশেষ একটা দিন।

বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মানুষজনের কাছে গুরু পূর্ণিমা কি ? বা গুরু পূর্ণিমার তাৎপর্য কি ? এই প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার অপেক্ষা রাখেনা। কথিত আছে আষাঢ়ি মাসের পূর্ণিমা তিথির দিন গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থ রূপে মাতৃগর্ভে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন এবং একই দিনে

গৌতম বুদ্ধ সন্যাস নিয়ে বোধিজ্ঞান লাভ করার পর উত্তর প্রদেশের সারনাথ নামক স্থানে আষাঢ়ি মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তার শিষ্যদের প্রথম উপদেশ দান করেন, তাই বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের কাছে গুরু পূর্ণিমার মাহাত্ম্য বা গুরু পূর্ণিমার তাৎপর্য অসীম।

হিন্দু ধর্মে প্রথম গুরু অথাৎ আদি গুরুর জন্মের দিনটি হল গুরু পূর্ণিমা। যোগ শাস্ত্রে ভগবান শিবকে আদি যোগী বলে গণ্য করা হয়। অথাৎ শিব হলেন আদি যোগী। ভগবান শিব যেদিন আদি দেব/ আদি যোগী থেকে, আদি গুরুতে রূপান্তরিত হলেন সেই দিনটি হল গুরু পূর্ণিমা।

হিন্দু ধর্মে শিব পুরাণে মহাদেব শিবকে, আদি গুরু বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আদি গুরু শিব আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে সাতজন ঋষি যথা – অত্রি, বশিষ্ঠ, পুলহ, অঙ্গীরা‚ পুলস্থ্য‚ মরীচি এবং ক্রতু এই সাত জন ঋষিকে (সপ্তঋষি) দীক্ষা দিয়ে মহাজ্ঞান প্রদান করেন।

মনে করা হয় আদি যোগী শিব এই দিনেই আদি যোগী থেকে আদি গুরুতে রূপান্তরিত হয়। তাই এই দিনটি হল হিন্দু শাস্ত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন এবং আদি গুরু শিবকে উৎসর্গকৃত গুরু পূজন করার জন্য বিশেষ দিনটি হল এই গুরু পূর্ণিমার দিন।

আজথেকে প্রায় ০৫ হাজার বছর আগে ঋষি বেদব্যাসের জন্ম হয়। মনে করা হয় মহাঋষি বেদব্যাস গুরু পূর্ণিমার দিনে জন্ম গ্রহণ করেন। তাই বেদব্যাসের জন্মতিথি হিসাবে গুরু পূর্ণিমাকে আবার অনেকে 'ব্যাস পূর্ণিমা' বলে থাকেন।

বেদব্যাসের পিতা হলেন ঋষি পরাশর এবং মাতা হলেন মৎস্যগন্ধা সত্যবতী। কথিত আছে বেদব্যাসের জন্মের পর তার মা সত্যবতী,তাকে পরিত্যাগ করেন। বেদব্যাস আষাঢ় মাসের শুক্ল পূর্ণিমা তিথিতে জনৈক একটি দ্বীপে জন্মলাভ করে।

মহাঋষি বেদব্যাসের আর এক নাম হল কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। জন্মের সময় বেদব্যাসের গায়ের রং শ্যামলা ছিল তাই বেদব্যাসকে ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বলা হয়। বেদব্যাস ছিলেন মহাপন্ডিত তিনি শ্রীমৎ ভাগবত গীতা এবং মহাভারত মহাকাব্য রচনা করেন।

এছাড়াও তিনি শত শাখাপ্রশাখাযুক্ত “বেদ” কে চার ভাগে ভাগ করেন, তার জন্যই তাকে বেদব্যাস বলা হয়। বেদব্যাসের জন্ম আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হয় এবং তার মাধ্যমেই গুরু শিষ্যের রীতি প্রচলন হয়।

গুরু পূর্ণিমার দিন তার শিষ্যরা ‘গুরু গীতা’ থেকে ২১৬ স্ত্রোত্র পাঠের মাধ্যমে “ব্যাস পূজা” করেন। মহাঋষি বেদব্যাসের গ্রহ, নক্ষত্র, গীতা, চন্দ্র, সূর্য্য, ভুত- ভবিষ্যত সমস্ত বিষয়েই পান্ডিত্য ছিল সবার উপরে।

সবমিলিয়ে তিনি ৬০ লক্ষ শ্লোক রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত এই সমস্ত শ্লোকের মধ্যে ৩০ লক্ষ শ্লোক ছিল শুধুমাত্র দেবী দেবতা অথাৎ দেবলোকের জন্যে। বাকি ১৫ লক্ষ শ্লোকের সংহিতা প্রচারিত হয়েছিল পিতৃ লোকের জন্যে,

১৪ লক্ষ শ্লোক রচিত হয়েছিল অক্ষ লোকের জন্য। আর বাকি ০১ লক্ষ শ্লোক মর্ত্যলোকের জন্যে। অষ্ট চিরঞ্জীবীর মধ্যে শুধুমাত্র একজন ছিলেন মহির্ষী, তিনি হলেন বেদব্যাস। তিনি হলেন জগতের গুরু। আর এইভাবে বেদব্যাসের জন্মদিনকে অনুকরণ করে প্রচলন হয় গুরু পূর্ণিমার।

অবশ্যই পড়ুন : সরস্বতী পূজা কেন করা হয়।

গুরু পূর্ণিমার গুরুত্ব (Guru Purnimar gurutwo)

গুরু পূর্ণিমা সমাজের সমস্ত ধরণের গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের বিশেষ একটা দিন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল, সেখানে গুরু পূর্ণিমার দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। হিন্দিতে গুরুকে নিয়ে একটি প্রবচন আছে –

‘ গুরু গোবিন্দ দুয়ো খাড়ে‚ কাকে লাগু পায় / বালিহারি গুরু আপনে যিন গোবিন্দ দিয়ো বতায়ে ‘

প্রবচনটির বাংলা সারমর্ম এই যে- যদি এমন কখনো পরিস্থিতি এসে যায়, যেখানে গুরু এবং ঈশ্বর দুজনের সামনে থাকে, তাহলে কাকে প্রথম পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করব ? তার পরের লাইনে উপরের বাক্যের সমাধান হিসাবে বলা হয়েছে যদি ঈশ্বর এবং গুরু দুজনেই

একই সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলে প্রথমে গুরুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হবে। তারপর ঈশ্বরকে প্রণাম করতে হবে। কারণ আমরা গুরুর হাত ধরেই ঈশ্বরকে চিনতে শিখি। তাই ঈশ্বরের আগে গুরুর স্থান।

গুরু পূর্ণিমা কি
গুরু পূর্ণিমা কি, গুরু পূর্ণিমার ইতিহাস, গুরু পূর্ণিমার তাৎপর্য

আমাদের জন্মলগ্ন শুরু হয় গুরুর সানিধ্য থেকে। মর্ত্যলোকে এসে আমাদের প্রথম গুরু মা-বাবার স্মরণাপন্ন হতে হয়। শুরুতে একজন নির্বাক শিশুকে মা-বাবাই তার সন্তানকে কোলে পিঠে করে খেতে, পড়তে, বলতে এবং চলতে শেখায়।

তারপর পাঠশালায় গিয়ে আবার আমরা শিক্ষা গুরুর সানিধ্য লাভ করি তিনি আমাদের অন্ধকার জীবনে বিদ্যারূপী শিক্ষার আলো প্রদান করে ভাল মন্দ জ্ঞান বিচার ভাবনা করার প্রকৌশল শেখান। তাইতো শাস্ত্রে বলা হয়েছে –

“গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু‚ গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ

গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ”

অথাৎ মনুষ্য জীবনে গুরুই হলেন ব্রহ্মা, গুরুই হলেন বিষ্ণু ও মহেশ্বর। তিনিই আমাদের জীব-দশায় সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন। সেই গুরু মাতা পিতা হোক, বা শিক্ষা গুরু হোক, সেই গুরুকে প্রণাম জানায়।

গুরু হল সমাজ সংস্কারক তথা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হিন্দু ধর্মের মানুষেরা গুরুকে ব্রহ্মা,বিষ্ণু, মহেশের রূপ হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তাইতো প্রতি বছর আষাঢ় পূর্ণিমার দিনে গুরু পূর্ণিমা পালিত হয়।

গুরু পূর্ণিমা কি, গুরু পূর্ণিমা কেন পালন করা হয়, গুরু পূর্ণিমার ইতিহাস, গুরু পূর্ণিমার মাহাত্ম্য

পরিশিষ্ট

গুরু পূর্ণিমা কি ? গুরু পূর্ণিমা কেন পালন করা হয় ? এবং আমাদের জীবনে গুরুর মাহাত্ম্য যে কতটা সেকথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমরা উপরের পঙতিতে গুরু পূর্ণিমা কি ? এবং গুরু পূর্ণিমা কেন পালন করা হয় ? গুরু পূর্ণিমার গুরুত্ব গোনা কয়েকটি ব্যাক্যে তুলে ধরলাম।

তবে গুরুর গরিমা বা গুরুর ঋণ কোনোদিন কোনো শিষ্যের পক্ষে মেটানো কোনোদিন সম্ভব নয়। তাই গুরু সব সময় গুরু হয়। শিষ্য গুরুর কাছে সমাদৃত হয়। আমরা চাই যুগে যুগে গুরু শিষ্যের মধুর সম্পর্ক যুগ যুগ বেঁচে থাকুক গুরু পূর্ণিমার মধ্যে দিয়ে।

5/5 - (3 votes)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here