প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী বাংলা,উইকিপিডিয়া (Premanand Maharajer Jiboni Bangla wikipidia)

আপনারা যারা নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন তারা ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রাম ভিডিও ক্রল করার সময় একজন হলুদ বস্ত্রধারী মাথায় হলুদ রঙের তিলক আঁকা পৌঢ় মহারাজের প্রবচনের ভিডিও দেখে থাকবেন।

সোশ্যাল মিডিয়ার সেই পৌঢ় মহারাজ হলেন আমাদের সকলের পরম পূজ্য প্রেমানন্দ মহারাজ। আমরা এখন বৃন্দাবন নিবাসী প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী উইকিপিডিয়া (Premanand Maharajer Jiboni Wikipedia Bangla) বাংলাতে আলোচনা করব।

আপনারা প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (Premanand Maharaj Biography Bangla) সম্বন্ধিত সমস্ত বৃত্তান্ত, প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনাদের সম্মুখে তুলে ধরব।

আপনারা পুরো আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়লেই প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী, প্রেমানন্দ মহারাজের জন্ম ও ছেলেবেলা, প্রেমানন্দ মহারাজের প্রবচন, প্রেমানন্দ মহারাজের বৃন্দাবনের আশ্রম ইত্যাদি ব্যাপারে সমস্ত কিছু জানতে পারবেন।

Table of Contents

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী বাংলা (Premanand Maharajer Jiboni Bangla)

আমরা এখন প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী উইকিপিডিয়া সম্বন্ধিত সকল ধরণের তথ্য প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী বাংলাতে আলোচনা করব। যার মাধ্যমে আপনারা প্রেমানন্দ মহারাজের জন্ম বৃত্তান্ত, মহারাজের ছেলেবেলা জীবন সংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পারবেন।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী উইকিপিডিয়া (Premanand Maharaj Jiboni Wikipedia Bangla)

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী উইকিপিডিয়াতে সংক্ষেপে একঝলক (Premanand Maharaj Biography Bangla) –

নাম প্রেমানন্দ মহারাজ।
ছেলেবেলার নাম অনিরুদ্ধ কুমার পান্ডে।
নাগরিকতা ভারতীয়।
গ্রামের নাম কানপুর জেলার, সরসোল ব্লকের, অখরী গ্রাম।
রাজ্য উত্তর প্রদেশ
পিতার নাম শ্রী শম্ভূ কুমার পান্ডে।
মাতার নাম শ্রীমতি রমা দেবী পান্ডে।
গুরুদেবের নাম শ্রী হিত গোবিন্দ শরণজী মহারাজ।
গুরুর সেবায় নিজেকে নিযুক্ত রাখেন প্রায় ১০ বছর
সম্প্রদায় রাধা বল্লভ সম্প্রদায়।
প্রথম সাধনাস্থল বেনারসের তুলসী ঘাট।
বর্তমান সাধনাস্থল বৃন্দাবন ধাম।
রোগ মহারাজের দুটো কিডনি খারাপ
তিনি গৃহত্যাগ করেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে
মহারাজজীর বর্তমান বয়স প্রায় ৬০ বছর
তিনি ভক্তি করেন শ্রীমতি রাধারানীর ভক্তি করেন
প্রেমানন্দ জী মহারাজের আশ্রম স্থান শ্রী বৃন্দাবন ধাম
মহারাজের ধর্ম হিন্দু সনাতন ধর্ম।
প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (premanand maharaj jiboni bangla )

প্রেমানন্দ জী মহারাজের জন্মপরিচয় (Premanand Maharaj Biography Bangla)

বর্তমান যুগে মানুষের সঙ্গে ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থার পরিচিতি ঘটানোর সমস্ত শ্রেয় সেই মহাপুরুষ ও সদ্গুরু জনকে দিতে হয়, যিনারা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভগবানের উপদেশ বিতরণ করে মানুষের সঙ্গে ভগবানের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজ করে চলেছেন ।

এই ধরণের সন্ত ও মহাপুরুষরা ঈশ্বরের বাণী প্রচার করে মানুষের মনে ঈশ্বরের ভাবনা জাগরিত করে। আজকালকার যুগে এমনি একজন নিরাময় সন্ত হলেন প্রেমানন্দ মহারাজ (Premananda Maharaj jiboni Bangla)।

শ্রী প্রেমানন্দ মহারাজের জন্ম হয় ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুর জেলার, অখরী নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বলা বাঞ্ছনীয় মহারাজের জন্মস্থান জানা গেলেও এখন পর্যন্ত শ্রী প্রেমানন্দ মহারাজের নির্দিষ্টভাবে কোন জন্মতারিখ জানা যায়নি।

প্রেমানন্দ মহারাজের জন্ম এক সাধারণ গরীব ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। মহারাজের পরিবারের লোকজন ঈশ্বর প্রেমী ছিলেন তারা সকলেই ভগবানের সেবায় ব্রতী থাকতেন। প্রেমানন্দ মহারাজের ঠাকুরদা নিজেও একজন সন্যাসী ছিলেন।

প্রেমানন্দ মহারাজের বাবা হলেন শ্রী শম্ভূ কুমার পান্ডে এবং মাতা হলেন শ্রীমতি রমা দেবী পান্ডে। পরিবারের সাথে সাধু সন্তের নিবীড় যোগাযোগ থাকায়, ছেলেবেলা থেকেই প্রেমানন্দ মহারাজের মনে ভগবানের প্রতি গভীর ভক্তিযোগ তৈরী হয়েছিল।

শুদ্ধ বস্ত্রে তিলক রঞ্জিত মাথায় তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ধরণের ধার্মিক গ্রন্থ পাঠ করতেন। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় শৈশব অবস্থাতেই প্রেমানন্দ মহারাজ হিন্দু শাস্ত্রের ১০ থেকে ১৫ রকমের বিভিন্ন ধরণের চালিশার শ্লোক মুখস্ত করে ফেলেন।

প্রেমানন্দ মহারাজের সন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ

প্রেমানন্দ মহারাজের পরিবারের আধ্যাত্মিক পরিবেশ কিশোর অবস্থাতেই প্রেমানন্দ মহারাজকে ভগবানের সাধনায় লীন হওয়ার পথ প্রস্তুত করে দিয়েছিল। মহারাজ ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরণের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতেন।

মহারাজের বাবা-মা সর্বদা সাধু সন্তদের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন। স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজের বড় দাদা বিভিন্ন জায়গায় ভাগবত কথা করে পরিবারের খরচা নির্বাহন করতেন। মহারাজের যখন মাত্র ০৫ বছর বয়স তখন থেকেই মহারাজ শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ও শ্রী সুখসাগর পড়া শুরু করেন।

বিদ্যালয় শিক্ষা নেওয়ার সময় মহারাজের বালকসুলভ মনে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্নের উত্তাল ঢেউ মহারাজের মনকে উথাল পাতাল করে দিত ? মহারাজের কৈশোর মন তখন " শ্রী রাম এবং কৃষ্ণ গোবিন্দ হরে মুরারী জপ করে" তার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করত।

মহারাজ নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় ঈশ্বরের খোঁজে আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করার জন্যে মনস্থির করেন। বাল্য অবস্থায় প্রেমানন্দ মহারাজের মনে বিচিত্র খেয়াল আসত, তার মনে হত জগৎ সংসারে সবাই কোনো না কোনোদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী

তাহলে এই মায়ার পৃথিবীতে তার সর্বশেষ সঙ্গী কে হবে ? এই সমস্ত ভেবে শেষ পর্যন্ত মহারাজ জগতের মায়া ত্যাগ করে, নিজেকে ভগবানের চরণে ব্রতী রেখে সন্যাস ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সন্যাসী জীবন যাপন করার সিদ্ধান্ত নেন।

মহারাজ তার পরিবারের সবথেকে বেশী মাকে স্নেহ করতেন। তাই মহারাজ তাঁর মনের ইচ্ছা মায়ের কাছে খুলে বলেন। কিন্ত মহারাজের মা রমা দেবী, পুত্রের কথায় ততটা মনোযোগ দেয়না। তাঁর মনে হয় ছেলের এই খেয়ালীপনা বড় হওয়ার সাথে সাথে হয়ত চলে যাবে।

এরপর মহারাজ রাত্রিবেলা বিছানায় শুতে গেলে মহারাজের মন ভোর বেলা আবার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এরপর মহারাজ তার মাকে মনের সমস্ত কথা খুলে বলেন। মহারাজ মাত্র ১৩ বছর বয়সে সংসারের মোহমায়া ত্যাগ করে সন্যাসী হয়ে যান।

প্রেমানন্দ মহারাজের সন্যাস ধর্ম পালন

প্রেমানন্দজী মহারাজ গৃহ ত্যাগ করার পর সন্যাস ধর্ম পালনে ব্রতী হন। কিন্ত সন্যাস জীবনে দীক্ষা নেওয়ার আগে তাকে ব্রহ্ম্যচর্যে দীক্ষা নিতে হয়। ব্রহ্মচর্য্য অবস্থায় প্রেমানন্দ মহারাজের নাম হয় “আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মচারী। “

এরপর মহারাজ সন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সন্যাসী জীবনে মহারাজের নাম হয় “স্বামী আনন্দাশ্রম।” শ্রী প্রেমানন্দ মহারাজ ঈশ্বরের সানিধ্য পাওয়ার জন্যে নিজেকে কঠিন তপস্যায় নিয়োজিত করেন। তিনি তার পুরো জীবন ভগবানের ভক্তি মার্গে নিজেকে লীন করে দেন।

দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি একান্ত এবং নিরিবিলিভাবে কাটাতে পছন্দ করতেন। ক্ষুধা মেটানোর জন্যে তিনি অন্ন ভিক্ষা করতেন। কখনো কখনো তিনি বেশ কয়েকদিন নিরন্তন ঈশ্বরের চিন্তায় লীন হয়ে, অন্ন ও জল গ্রহণ না করেই উপবাসে দিন কাটিয়ে দিতেন।

প্রেমানন্দ মহারাজ জাগতিক চেতনার উপরে গিয়ে সংসারের মোহ মায়া ত্যাগ করে স্বাত্বিক জীবন যাপন করতেন। এরপর তিনি আকাশবৃত্তি গ্রহণ করেন (আকাশবৃত্তি মানে ব্যক্তিগতভাবে কোনো রকম প্রয়াস না করে,

জাগতিক বস্তুর মোহ ছাড়াই শুধুমাত্র ভগবান যেটুকু দিয়েছেন,সেটুকুতেই নিজেকে সন্তস্ট রেখে জীবন যাপন করা) সন্যাসী অবস্থায় মহারাজের বেশিরভাগ সময় গঙ্গা নদীর তীরে অতিবাহিত হত।

সন্যাসী হওয়ার পর মহারাজ লৌকিক মায়া ত্যাগ করে দিয়েছিলেন,তাই মহারাজ কোনোদিন আশ্রমে থাকা পছন্দ করতেন না। প্রেমানন্দ মহারাজ গঙ্গা নদীকে তার দ্বিতীয় মা মনে করতেন।

তাই তিনি ক্ষুধা,অন্ন, বস্ত্র, জলের পরোয়া না করে, কখনো তিনি বেনারস তো কখনো আবার হরিদ্বারের গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়াতেন। মহারাজের জীবনশৈলীতে কোনো পরিবর্তন ছিলনা বছরের সারা সময় তিনি একইভাবে জীবনযাপন করতেন।

তিনি যেমন অঘ্রাহায়নের শীতে গায়ে শীতবস্ত্র পড়তেন না, আবার বর্ষার বৃষ্টিতে মাথায় ছাতা ধরতেন না। তবে তিনি নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও সন্ধেবেলা, তিনবার করে গঙ্গা স্নান করতেন।

উপবাস ব্রত পালন করার সময় মহারাজ কখনো,কখনো একটানা বেশ কয়েকদিন না খেয়েই দিন কাটিয়ে দিতেন। প্রেমানন্দ মহারাজের কথায় তিনি দিনে শুধু একবার ভিক্ষার জন্যে বার হতেন এবং দিনের নির্দিষ্ট কোনো এক সময় তিনি ১০ থেকে ১৫ মিনিট ভিক্ষা পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতেন।

এই সময়ের মধ্যে তিনি যদি ভিক্ষা পেতেন, তাহলে তিনি ভিক্ষা গ্রহণ করতেন। আর যদি এই সময়ের মধ্যে তিনি কোনো ভিক্ষা পেতেন না, তাহলে তিনি গঙ্গার জল পান করে ক্ষুধা নিবারণ করতেন।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী
প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী

অনেক সময় মহারাজ ভোজন না পেয়ে এভাবেই ক্ষুদার্থ অবস্থায় গঙ্গাজল গ্রহণ করে খিদে ও তৃষ্ণা নিবারণ করতেন। প্রেমানন্দ মহারাজ বলেন বেনারসের ঘাটে এইভাবে তাঁর সন্যাসী দশায় জীবন কাটতে কাটতে, একদিন সত্যি সত্যি ভগবান শিব তাকে দর্শন দেন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করেন।

অবশ্যই পড়ুন : গুরুপূর্ণিমা কেন পালন করা হয়।

প্রেমানন্দ মহারাজ বৃন্দাবন কীভাবে এলেন (Premanand Maharaj Brindabon Kivabe Elen)

শ্রী প্রেমানন্দ জী মহারাজের জীবনীর (Premanand Maharaj Biography Bangla) এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হল শ্রী প্রেমানন্দ মহারাজের বেনারস থেকে বৃন্দাবন আগমন। প্রেমানন্দ মহারাজের কাশী (বেনারস) থেকে শ্রী বৃন্দাবন ধামে আসার এক বিস্ময়কর গল্প আছে।

শ্রী প্রেমানন্দ মহারাজ বেনারসের (কাশী ধাম) ঘাটে গঙ্গার তীরে অশ্বত্থ গাছের তলায় বসে ভগবান শিব ও মা গঙ্গার নাম জপ করতেন। ভগবান ভোলানাথের কৃপায় হঠাৎ করে তার মনে একদিন বৃন্দাবন যাওয়ার ইচ্ছা জাগে।

এরপর মহারাজ মনে মনে বৃন্দাবন যাওয়ার কথা চিন্তা করতে করতে ধ্যান থেকে থেকে উঠে চলে যান এবং মনে মনে চিন্তা করেন যা হবে দেখা যাবে এই কথা চিন্তা করে প্রতিদিনের ন্যায় ভিক্ষা পাওয়ার আসায় ভিক্ষার লাইনে ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।

পরের দিন মহারাজ নিত্যদিনের মত গঙ্গাতীরে তুলসী ঘাটে বসেছিলেন, তখন একজন অপরিচিত সাধু আসেন এবং মহারাজকে বলেন মহারাজ “শ্রী হনুমান প্রসাদ পোদ্দারের অন্ধ বিশ্ববিদ্যালয় কাশীতে” শ্রী রামশর্মা আচার্য দ্বারা একটি ধার্মিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

সেখানে দিনে শ্রী চৈতন্য লীলা এবং রাত্রী বেলা রাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে, চলুন আমরা দুজনে গিয়ে সেই ধার্মিক অনুষ্ঠান দেখে আসি। মহারাজ এর পূর্বে কোনোদিন রাসলীলা দেখেননি, তাই তাঁর মনে হয়েছিল গ্রামে যেমন রামলীলা হয়, সেরকমই হয়ত এখানেও রাসলীলার অনুষ্ঠান হবে।

সেইজন্য মহারাজ প্রথমে যেতে চাননা এবং অপরিচিত সাধুটিকে রাসলীলা দেখতে যাওয়ার জন্যে মানা করে দেন। তখন সাধুটি বলেন আরে মহারাজ রাসলীলার অনুষ্ঠান করার জন্যে বৃন্দাবন থেকে শিল্পীরা এসেছেন, তারা এখানে পুরো একমাস ধরে রাসলীলা অভিনয় করবে।

এরকম সুযোগ বার বার আসবেনা, চলুন আমরা দুজনে মিলে রাসলীলা দেখে আসি সেখানে গিয়ে আপনার খুব আনন্দ হবে। মহারাজ তখন সাধুটিকে বলেন, আপনার যাওয়ার থাকলে যান আমি কোনো রাসলীলা দেখতে যাবনা, আমি এই গঙ্গার ঘাটে মহাদেবের স্মরণে বেশ আছি।

আর ! আপনি আমাকেই এত তোষামোদ করছেন কেন ? আপনার রাসলীলা দেখার ইচ্ছে থাকলে আপনি যান। তখন সাধু মহারাজ, আরো একবার প্রেমানন্দ মহারাজকে রাসলীলা দেখতে যাওয়ার জন্যে বলেন, আরে মহারাজ আপনি একবার চলুন তো আগে,

আপনার যদি রাসলীলা দেখতে ভালোলাগে তাহলে দেখবেন নইলে আপনাকে আমি আর কোনোদিন যেতে বলব না। এতবার সাধু মহাশয়ের অনুরোধ করার পর প্রেমানন্দ মহারাজের মনে হয় হয়তো ভোলানাথের সেটাই ইচ্ছা, নইলে বার বার সাধু মহারাজ আমাকে তোষামোদ করতে যাবে কেন ?

এরপর মহারাজ সাধুমহারাজের সঙ্গে রাসলীলা দেখতে যাওয়ার জন্যে রাজী হয় এবং সাধুটির সাথে রাসলীলা দেখতে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন দিনের বেলা শ্রী চৈতন্য লীলা মঞ্চস্থ হচ্ছিল এরপর মহারাজ শ্রী চৈতন্যলীলা দেখেন এবং প্রেমানন্দ মহারাজ সেই চৈতন্যলীলার রস আস্বাদন করে খুবই আনন্দিত হন।

এরপর রাত্রী বেলা সাধুমহারাজকে রাসলীলা দেখতে যাওয়ার জন্যে নতুন করে আর তোষামোদ করতে হয়না। মহারাজ নিজে থেকেই স্বাগ্রহে রাসলীলা শুরু হওয়ার আগেই মঞ্চের সামনে গিয়ে উপস্থিত হন। শ্রী চৈতন্য লীলা এবং রাস লীলা দেখে মহারাজ গভীরভাবে প্রভাবিত হন

এবং টানা একমাস নিয়ম করে শ্রী চৈতন্যলীলা এবং রাসলীলার স্বাদ আস্বাদন করেন। এরপর মহারাজ প্রতিদিন নিয়মকরে লীলা দেখতে যেতেন এবং সেই লীলা দেখে আনন্দের সাথে ফিরে আসতেন।

প্রেমানন্দ জী মহারাজের জীবনী (premanand maharaj jiboni bangla)

এরকমভাবে রাসলীলা ও শ্রী চৈতন্যলীলা দেখতে দেখতে একমাস সময় কেটে যায় এবং রাসলীলা ও শ্রীচৈতন্য লীলা শেষ হয়ে আসে। চৈতন্য লীলার সকল শিল্পী বেনারস ছেড়ে বৃন্দাবন ধামে ফিরে যাচ্ছেন।

রাসলীলা ও শ্রী চৈতন্যলীলা শেষ হয়ে গেলে তিনি কী করে রাসলীলা এবং চৈতন্য লীলার স্বাদ আস্বাদন করবেন মহারাজ এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরেন ! মহারাজ রাসলীলা ও শ্রী চৈতন্য লীলা দেখতে পাবেন না বলে মহারাজের মনে হাহাকারের সৃষ্টি হয়।

মহারাজ সারাক্ষন চিন্তা করতে থাকেন এখন তাহলে আমি কী করব ? আমি কীভাবে বাঁচব ? যাইহোক আমাকে যে কোনো উপায়ে বৃন্দাবন যেতেই হবে। মহারাজের মনে হয় রাসলীলা এবং চৈতন্য লীলার সকল শিল্পী যেহেতু বৃন্দাবনের

সুতরাং তারা নিশ্চয় বৃন্দাবনে গিয়ে রাসলীলা এবং চৈতন্য লীলা অভিনয় করবে ? আর এই সমস্ত শিল্পীরা কোথাও না কোথাও যেহেতু রাসলীলা অভিনয় করতে থাকে, তাই এই সমস্ত শিল্পীদের সঙ্গে আমি যদি যায় তাহলে আমি প্রত্যেকদিন রাসলীলা দেখতে পাব।

এর পরিবর্তে না হয় আমি শিল্পীদের সেবা করব। মহারাজ মনে মনে সেই প্রস্তাব নিয়ে রাসলীলার সঞ্চালকের কাছে পৌঁছায় এবং তার পা ছুঁয়ে সষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন। এরপর প্রেমানন্দ মহারাজ তার মনের সমস্ত কথা সঞ্চালকের কাছে খুলে বলে, বলেন-

“আমি গরীব সন্যাসী, আমার কাছে আপনাকে দেওয়ার মত পয়সা নেই, তবে আমি আপনার আজীবন সেবা করব পরিবর্তে আমি আপনাদের রাসলীলার অভিনয় দেখব।”

মহাশয় আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না, আপনি আমাকে আপনার দলের সাথে নিয়ে চলুন। রাসলীলা দলের সঞ্চালক তখন অত্যন্ত বিনম্ৰতার সাথে প্রেমানন্দ মহারাজকে বলেন, দেখুন বাবা আপনাকে আমাদের সাথে নেওয়া সম্ভব নয়।

মহারাজ সঞ্চালকের কাছে এই প্রতিউত্তর শুনে বলেন আমি শুধু আপনাদের সাথে থেকে রাসলীলার অভিনয় দেখতে চায়, আর কিছু চায় না। তখন রাসলীলা দলের সঞ্চালক মহারাজকে বলেন, মহারাজ –

“আপনি শুধু একবার বৃন্দাবনে তো আসুন। একবার বৃন্দাবনে এলে বাঁকে বিহারি আপনাকে আর যেতে দেবেনা।”

প্রেমানন্দ মহারাজ বলেন রাসলীলা দলের সঞ্চালকের এই বাক্য আমার জীবন বদলে দেয়। আমি সঞ্চালকের এই বাক্যটিকে গুরুমন্ত্র মনে করি এবং রাসলীলার সঞ্চালককে আমার গুরু।

এঘটনার পরে মহারাজের মনে সবসময় বৃন্দাবন যাওয়ার বাসনা জাগতে থাকে, আমি বৃন্দাবন যাব, আমাকে বৃন্দাবন যেতে হবে। প্রিয় পাঠকগণ আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ভগবানের কিরকম অপরূপ লীলাখেলা –

কাল পর্যন্ত যে মহারাজ ভগবান ভোলানাথের নিত্য পূজা করত এবং ভজন কীর্ত্তন নিয়ে একান্তভাবে নিরিবিলি জীবন কাটাতেন। আজ সেই মহারাজ বৃন্দাবন যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ছেন। মহারাজের জীবনের ঘটনাগুলোকে যদি একের পর এক সাজিয়ে দেখা হয়,

তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় শুধুমাত্র ভগবানের অসীম কৃপা ছাড়া এসব কিছু সম্ভব হতনা। মহারাজের মনে প্রেরণা আসা বৃন্দাবন কেমন হবে ? তারপর সেইসময়েই কাকতালীয়ভাবে রাসলীলার আয়োজন ! আবার সেই রাসলীলার সূচনা কোনো অপরিচিত সাধু দ্বারা মহারাজের কাছে পৌঁছানো।

তারপর একপ্রকার জোরকরে মহারাজকে রাসলীলা দেখতে নিয়ে যাওয়া, এরপর মহারাজের বৃন্দাবন ধাম যাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হওয়া সব কিছুই যেন ঈশ্বর একের পর এক সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল। আসলে এইসব ছিল পরম করুনাময় ঈশ্বরের অসীম ইচ্ছা।

এইভাবে একমাস রাসলীলার স্বাদ নেওয়ার পর প্রেমানন্দ মহারাজ পুনরায় বেনারসের গঙ্গার ঘাটে সন্যাসীর ন্যায় জীবন যাপন করতে থাকেন। প্রতিদিন তিনবার গঙ্গা স্নান, ভিক্ষার লাইনে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা পেলে ভিক্ষা গ্রহণ, নচেৎ গঙ্গাজল সেবন করে ক্ষুধার নিবারণ করা।

তবে মহারাজের নিত্যদিনের এই পুরোনো দিনচর্যায় নতুন একটা বিষয় যোগ হয় মহারাজের মনে বৃন্দাবন যাওয়ার ইচ্ছা জাগা। “আমাকে বৃন্দাবন যেতে হবে।” এইভাবে কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর, একদিন সকালবেলা মহারাজ বেনারসের তুলসীঘাটে মহারাজ ধ্যানে বসে ছিলেন,

তখন পাশের সংকট মোচন হনুমান মন্দিরের বাবা যুগল কিশোর, হনুমানের প্রসাদ নিয়ে মহারাজের কাছে পৌঁছলেন। যুগল কিশোর মহারাজকে প্রসাদ নেওয়ার জন্যে হাত পাততে বললেন।

এখানে সমস্যা হল প্রেমানন্দ মহারাজ হলেন একান্তবাসী যোগী মানুষ, তিনার সাথে বাইরের লোকের সেরকম কোনো পরিচয় নেই, আর কোনো অপরিচিত মানুষজনের কাছ থেকে মহারাজ কখনো কোনো কিছু গ্রহণ করেন না। তাই তিনি প্রসাদ নিতে রাজী হলেন না।

যুগল কিশোর তখন মহারাজকে উদ্দেশ্য করে বললেন আমার মন থেকে ভগবান আপনাকে প্রসাদ দেওয়ার জন্যে প্রেরণা দিয়েছে, সেই জন্যই আমি আপনাকে প্রসাদ দেওয়ার জন্যে এসেছি। নইলে দেখুন এই বেনারসের গঙ্গার ঘাটে আরো কত সাধু সন্ত আছে

আমার তাদেরকে প্রসাদ দেওয়ার প্রেরণা না এসে আপনাকে প্রসাদ দেওয়ার প্রেরণা কেন এলো ? তাহলে আপনি বলুন। সুতরাং মহারাজ আপনি এই প্রসাদ গ্রহণ করুন। এঘটনার পর যখন মহারাজের মনে হয় বাবা যুগল কিশোর হল তার হিতাকাঙ্খী এবং

প্রসাদ বিতরণের পিছনে তার কোনো স্বার্থ নেই। যুগল কিশোর নিষ্কাম ভাবনা নিয়েই তাকে প্রসাদ দেওয়ার জন্যে এসেছিলেন তখন প্রেমানন্দ মহারাজ যুগল কিশোরের থেকে প্রসাদ গ্রহণ করেন। মহারাজ যুগল কিশোরের কাছ থেকে প্রসাদ গ্রহণ করে খুবই প্রসন্ন হন এবং গঙ্গাজল গ্রহণ করেন।

এরপর যুগল কিশোর মহারাজকে তার কুটিরে যাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানায়। মহারাজ বলেন না, এটা আমার নিয়ম নয়। আমি কোনো গৃহস্থের দ্বারে গিয়ে ভিক্ষা নিই না আর গৃহস্থের ঘরে গিয়ে ভোজন করিনা।

খোলা আকাশের নিচে থেকে ভগবান যেটুকু জোটাই সেটুকু পেয়েই আমি সন্তুষ্ট থাকি। তখন যুগল কিশোর মহারাজ নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন আমি নিজেও একজন বাবাজী। এরপর মহারাজ স্নেহবশতঃ যুগল কিশোর মহারাজের কুটিরে যাওয়ার জন্য রাজি হয়।

যুগল কিশোর নিজের হাতে রান্না করে প্রেমানন্দ মহারাজকে ডাল রুটি বানিয়ে খাওয়ায়। যুগল কিশোরের হাতে রান্না খেয়ে মহারাজের ক্ষুধা নিবারণ হয়। কিন্তু পেটের ক্ষিদে মিটে গেলেও মহারাজের মনের ক্ষিদে কিন্তু তখন মেটেনি।

পরিস্তিতি যেমনই হোক না কেন মহারাজের মনে একটা কথা সব সময় নাড়া দিত আমাকে বৃন্দাবন যেতে হবে, আমি কি করে বৃন্দাবনে যাব ? যুগল কিশোরকে দেখে মহারাজের ভালো মানুষ মনে হয়।

তাই মহারাজ মনের কথা ধরে না রাখতে পেরে যুগল কিশোরের কাছে বলে ফেলেন – “আপনি কী আমাকে বৃন্দাবন যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। ” ভগবানের নিয়তিতে হয়তো এটাই লেখা ছিল – যুগল কিশোর মহারাজের কাছে যেন এই কথাটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছিল।

মহারাজের মুখ থেকে বৃন্দাবন যাওয়ার কথা শোনা মাত্রই, যুগল কিশোর মহারাজকে বলে উঠলেন হ্যাঁ অবশ্যই, বলুন কবে আপনি যেতে চান। মহারাজ তখনই বলে উঠলেন আপনি চাইলে এখনই যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন, আমি তো যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়েই আছি।

যুগল কিশোরের কাছে বৃন্দাবন যাওয়ার কথা শুনে মহারাজের রোম রোম রোমাঞ্চিত হয়ে সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মহারাজ কালকে বৃন্দাবন যাওয়ার কথা শুনে মনে মনে খুবই আনন্দিত হয়।

সেইসময় বেনারস থেকে বৃন্দাবন যাওয়ার কোন ডাইরেক্ট রেলগাড়ী ছিল না। তাই মহারাজ যুগল কিশোরের সঙ্গে চিত্রকূটে আসেন। চিত্রকূটে দুজনে তিন-চার দিন থাকার পর, যুগল কিশোর মহারাজকে মথুরা যাওয়ার রেলগাড়ীতে চড়িয়ে দেন।

রেলগাড়ীতে চড়ার পর মথুরা যাত্রার সময় মহারাজের সঙ্গে আরো দুই জন লোকের পরিচয় হয়। তারা মহারাজের বিচারধারা শুনে প্রভাবিত হয়ে মহারাজকে কিছু টাকা পয়সা দেওয়ার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করে।

মহারাজের কাছে সেই সময় কোনো টাকা পয়সা না থাকলেও মহারাজ সেই ব্যক্তিদের কাছে টাকা পয়সা নিতে অস্বীকার করে। কেননা মহারাজ মনে করতেন-

”পরমপিতা জন্ম যখন দিয়েছেন, তখন তিনিই অন্নবস্ত্র, মাথার উপর ছাত তিনি দেবেন ,তিনি আমার খবর ঠিকই রাখবেন ”

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (premanand maharaj biography bangla)

তখন ঐ দুজন ব্যক্তি মহারাজকে বললেন আমরা দুজনে মথুরা যাচ্ছি, আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। আমরা রাত্রে আজ যেখানে বিশ্রাম করব, আপনিও আজকের রাতটুকু আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে কালকে সকালে বৃন্দাবন চলে যাবেন।

মহারাজ ছিলেন সহজ সরল স্বভাবের মানুষ, তিনি আগে পিছে কোনো রকম চিন্তা না করেই তাদের কথায় রাজি হয়ে যান। মহারাজ বলেন ঠিক আছে আজকের রাতটুকু তাহলে তোমাদের সঙ্গে থেকে যাব, কালকে না হয় আমাকে বৃন্দাবনে পৌঁছে দিও।

মথুরা পৌঁছে মহারাজকে তারা রাধেশ্যাম গেস্টহাউসের বাইরে বসিয়ে অপেক্ষা করতে বলে, গেস্ট হাউসের ভিতরে চলে যায়। রাত্রি বেলা শীতের সময় মহারাজ গেস্ট হাউসের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে।

এইভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় মহারাজকে ডাকার জন্যে কেউ এগিয়ে আসেনা। মহারাজ এই অমানৱীয় ব্যবহারে কোনো ধ্যান জ্ঞান না দিয়ে, মহারাজ বৃন্দাবনে এসেছেন সেই খুশিতেই প্রসন্ন হয়ে রাত কাটিয়ে দেয়।

মহারাজ বৃন্দাবনে আসার খুশি নিয়েই রাধেশ্যাম গেষ্ট হাউসের বাইরে বসেছিলেন। রাত্রী প্রায় ১১ টা বাজে এমন সময় জনৈক একজন ব্যক্তি মহারাজের কাছে এগিয়ে এসে বললেন জয় শ্রী কৃষ্ণ মহারাজ। কী ব্যাপার আপনি এখানে বাইরে বসে আছেন কেন ?

মহারাজ তখন পুরো ঘটনা তার কাছে খুলে বলেন। তখন সেই বিশিষ্ট ব্যক্তি মহারাজকে তার ঘরে নিয়ে যায় এবং তাকে পেট ভোরে ভোজন করায় ও রাত্রে বিশ্রাম করার জন্যে নিজের গৃহে ঠাঁয় দেয়।

পরের দিন সকাল হতেই মহারাজ সবার আগে যমুনার তীরে গিয়ে পৌঁছান। সেই দিনটি ছিল একাদশীর দিন। মহারাজ যমুনা নদীতে স্নান করে সোজা ভগবান শ্রী কৃষ্ণের দর্শন করার জন্যে শ্রী দ্বারিকাধিসের মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হন।

অবশ্যই পড়ুন : একাদশী কেন পালন করা হয়।

প্রেমানন্দ মহারাজের বৃন্দাবন আশ্রম ও ভক্তিমার্গের জীবন (Premanand Maharajer Brindabon Ashrom o Bhaktimarger Jibon)

শ্রী চৈতন্য লীলা ও রাসলীলার রস আস্বাদন করে, রাধাকৃষ্ণের প্রেমে মোহিত হয়ে শ্রী প্রেমানন্দ মহারাজ (Premanand Maharaj) বেনারস থেকে বৃন্দাবনে পৌঁছান। বৃন্দাবন গিয়ে শুরুর দিকে মহারাজ বৃন্দাবন ধাম পরিক্রমা করতেন এবং বাঁকে বিহারীর (শ্রী কৃষ্ণের) রূপ দর্শন করতেন।

এমনি একদিন মহারাজ শ্রী কৃষ্ণের রূপ দর্শন করার জন্যে বাঁকে বিহারি মন্দিরে গিয়ে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের রূপ দর্শন করতে করতে শ্রী কৃষ্ণের রুপে মোহিত হয়ে একদৃষ্টিতে কৃষ্ণের পানে পানে চেয়ে চেয়ে দেখছেন আর কেঁদেই চলেছেন।

তার দুই চোখ বেয়ে চোখের জলের বন্যা বইছে। যেন সাক্ষাৎ ভগবানের সঙ্গে ভক্ত তার বহু জন্মের সুখ দুঃখের কথা বিনিময় করে মনের বোঝ হালকা করছেন। এমনিভাবে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের পানে চেয়ে চেয়ে দেখতে দেখতে মহারাজ হঠাৎ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী উইকিপিডিয়া বাংলা (premanand maharajer jiboni wikipidia bangla)

প্রেমানন্দ মহারাজের এমন রূপ দেখে মন্দিরে আসা আরো অন্যান্য ভক্তরা সবাই অবাক হয়ে যায়। মন্দিরে এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে যায় যেন ভগবান স্বয়ং তার ভক্তকে ডেকে নিজের আত্মস্বরূপ প্রকাশ করে দর্শন দিয়েছেন। ব্যাপারটা দেখে পুরো মন্দির প্রাঙ্গনে ভক্তদের হৈ-চৈ পড়ে যায়।

মন্দিরে ভগবান ও ভক্তের এক আলাদা প্রেম বাৎসল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ভক্তরা বাবাকে নিয়ে বিভিন্ন ধরণের কানাঘুসো চর্চা শুরু করে দেয়। দাড়ি ওয়ালা জটাধারী এক মহারাজ কেমন ভগবানের প্রেমে মোহিত হয়ে অশ্রু বিসর্জন করছেন।

এইভাবে কিছুক্ষন সময় কাটতে না কাটতেই মহারাজের চারিদিকে অজস্র ভক্তের ভিড় জমে যায়। তাদের মধ্যে কেউ মহারাজকে ফুলের মালা পড়িয়ে দেয়, আবার কেউ কেউ মহারাজের চরণ স্পর্শ করে আশীর্বাদ নেয়।

মন্দির প্রাঙ্গনে এই ধরণের গতিবিধি যখন মন্দিরের আচার্য্যের দৃষ্টিগোচর হয়, তখন মন্দিরের আচার্য্য বিষয়টি দেখে কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। তখন ভিড় থেকে একজন ভক্ত বাবাকে আওয়াজ দিয়ে চিৎকার করে বলেন বাবা আপনি আদেশ করুন, আমি আপনার সেবা করার জন্য প্রস্তুত আছি।

মহারাজের মনে তো শুধু একটাই ইচ্ছে ছিল, আমাকে বৃন্দাবন যেতে হবে, আমি বৃন্দাবনে যেতে চায়। মহারাজ তখন সেই ভক্তটির উদ্দেশ্যে বললেন হে অনুজ আমাকে বৃন্দাবনে পৌঁছে দিতে পারবে। তখন ভক্তটি বললেন বাবা আপনি বৃন্দাবনে কোথায় যেতে চান ?

প্রেমানন্দ মহারাজের বাঁকে বিহারীর (শ্রী কৃষ্ণের ) কৃপা লাভ

প্রেমানন্দ মহারাজের কাছে বৃন্দাবন যাত্রা ছিল একেবারে নতুন। তাই তিনি বৃন্দাবনের নির্দিষ্ট করে কোনো ঠিকানা চিনতেন না বা জানতেন না তাই তিনি নির্দিষ্টভাবে কোনো জায়গায় যেতে চান ভক্তটিকে কিছু বলতে পারছিলেন না।

তবে তিনি বেনারসের কোনো সৎসঙ্গে বৃন্দাবনের রমনরেতি নামের একটি জায়গার নাম শুনেছিলেন। তাই অনাবশ্যক মহারাজের মুখ থেকে বৃন্দাবনের রমনরেতি যাব কথাটি বার হয়ে যায়।

ভক্তটি মহারাজকে মথুরা থেকে বৃন্দাবনে যাওয়ার জন্যে একটি গাড়ীর ব্যবস্থা করে দেয় এবং গাড়ীর ড্রাইভারকে মহারাজকে রমনরেতির তিনমাথার মোড়ে নামিয়ে দেওয়ার জন্যে বলে দেন।

প্রেমানন্দ মহারাজ বৃন্দাবনে পৌঁছে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছিলেন। কারণ তিনি একাদশীর দিন বৃন্দাবনে এসে পৌঁছেছিলেন। একাদশীর দিন রমনরেতিতে বহু ভক্ত নগরপরিক্রমণ করছিল।

ভক্তদের ভীড় নগর পরিক্রমা মহারাজ বৃন্দাবনে নতুন অতিথী হওয়ায় তিনি এসবের কিছু বুঝতে পারছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল এসব নিত্যনতুন অনুষ্ঠান হয়ত বৃন্দাবনে প্রায়শ হতেই থাকে হয়ত !

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী
প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী

এইভাবে ভক্তদের ভীড়ে মহারাজ কিছুক্ষন নগরপরিক্রমন করার পর মহারাজের সঙ্গে সন্ত শ্রী শ্যাম সখা মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিনি শ্রী শ্যাম সখা মহাশয়ের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলেন।

বাবা আমি বাঁকে বিহারীর দর্শন করার জন্যে বেনারস থেকে এসেছি, আপনি যদি কৃপাকরে বৃন্দাবনে আপনার শ্রাদ্ধের মধ্যে দুই-চার দিন থাকার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে খুবই উত্তম হয়। এরপর শ্রী শ্যাম সখা মহাশয় সমাদরের সঙ্গে মহারাজকে সন্ত শ্রী জগদানন্দের আশ্রমে নিয়ে যায়।

শ্রী জগদানন্দের আশ্রমে পৌঁছে শ্রী জগদানন্দ মহারাজের কাছে মহারাজ তার পুরো যাত্রাপথের বিবরণ দেয়। শ্রী জগদানন্দ মহারাজ একজন সমাজসেবী সাধু সন্ত প্রেমী উদার মনের মানুষ, তার আশ্রমে প্রতিদিন ৫০-১০০ জন সাধু সন্ত অন্ন গ্রহণ করেন।

প্রেমানন্দ মহারাজের শ্রী জগদানন্দ মহাশয়ের আশ্রমে আশ্রয় হয়। এরপর মহারাজ আশ্রমে থেকে বৃন্দাবন এবং ব্রজমন্ডল পরিক্রমণ করেন এবং তিনি সেইসব জায়গা ভ্রমণ করে খুব আনন্দিত হন।

আশ্রমে দুই-চার দিনের মতামত বিনিয়ময়ে শ্রী জগদানন্দ মহাশয়ের সঙ্গে প্রেমানন্দ মহারাজের মধ্যে এক সুমধুর সম্পর্ক তৈরী হয়। কিন্তু মহারাজ শুরু থেকেই একান্তবাসী ছিলেন এবং তিনি একান্তে নিরিবিলিতে থাকতে ভালবাসতেন।

অন্যদিকে জগদানন্দ বাবার আশ্রমে ভক্তদের আনাগোনা লেগেই থাকত, সেইজন্য মহারাজ পুনঃরায় বৃন্দাবন থেকে বেনারসে ফিরে যান। কিন্ত বৃন্দাবন থেকে বেনারস যাত্রা করার সময় মহারাজের একরকম অস্বস্তি অনুভব করেন।

মহারাজের মনে হয় হয়ত যাত্রাপথের ক্লান্তির জন্যে হয়ত তার এরকম অস্বস্তি লাগছে, কিন্তু তার এই অস্বস্তি কিছুতেই থামতে চাইনা। মহারাজ যখন বেনারসে ছিলেন তখন তার যেমন বৃন্দাবন আসার জন্যে মন ব্যাকুল হয়ে পড়ছিল এবং মহারাজের এই ব্যাকুলতা শেষ পর্যন্ত বৃন্দাবনে পৌঁছেই ক্ষান্ত হয়েছিল।

যাইহোক মহারাজ এখানে নিজের ভুল বুজতে পারেন এবং তিনি দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব পুনঃরায় বৃন্দাবনে জগদানন্দ বাবাজির রমনরেতির আশ্রমে ফিরে আসেন। আশ্রমে ফিরে মহারাজের সেই ব্যাকুলতার অবসান হয়।

অবশ্যই পড়ুন : শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী কেন পালন করা হয়।

শ্রী হিত প্রেমানন্দ মহারাজ কে

মন্দিরের পূজারী আচার্য্য আদরিনীয় গোস্বামী মহাশয় বিষয়টা দেখে মহারাজের প্রতি স্নেহ বিকশিত হয়, তারপর আচার্য্য শ্রী হিত মোহিত কুমার গোস্বামী মহারাজের উদ্দেশ্যে রাধা সুধা নিধির একটি শ্লোক গেয়ে শোনান।

কিন্ত আশ্চর্য্যের বিষয় প্রেমানন্দ মহারাজ নিজে সংস্কৃতে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও গোস্বামী মহাশয়ের গাওয়া সংস্কৃত শ্লোকটির আন্তরিক ভাবার্থ্য বুঝতে পারেন না। তখন গোস্বামী মহাশয় মহারাজকে শ্রী হরিবংশ এর নাম জপ করতে বলেন।

কিন্তু মহারাজ এই বিষয়ে ততটা গুরুত্ব না দিয়ে পরের দিন বৃন্দাবন পরিক্রমার সময় মহারাজ স্বয়ং শ্রী হরিবংশ মহাপ্রভুর কৃপায় সেই পবিত্র নাম জপ করতে থাকেন এবং তিনি সেই হরিবংশ শক্তির প্রতি মোহিত হয়ে যান ।

একদিন প্রাতঃভ্রমণ করার সময় মহারাজ বৃন্দাবনে এক সখীকে এক শ্লোক গাইতে শোনেন এবং তিনি সখীর মুখে সেই শ্লোক শুনে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি সখীর কাছে শ্লোকটির ভাবার্থ জানতে চাইলে, সখী হেঁসে পড়ে মহারাজকে বলেন এই শ্লোকের অর্থ জানতে হলে আপনাকে রাধাবল্লভ হতে হবে।

সখীর মুখে এই কথা শুনে মহারাজ দেরি না করে স্ব-আগ্রহে উৎসাহের সঙ্গে দীক্ষা নেওয়ার জন্যে মোহিত মরাল গোস্বামীর কাছে গিয়ে উপস্থি হন। তিনি প্রেমানন্দ মহারাজকে রাধাবল্লভ মন্ত্রে দীক্ষিত করে, রাধাবল্লভ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করেন।

এই ঘটনার কিছুদিন পরে শ্রী গোস্বামী মহাশয়ের পরামর্শে প্রেমানন্দ মহারাজ তার নিজ সদ্গুরু শ্রী হিত গোবিন্দ স্মরণ মহারাজ (Premanond Moharaj Guru) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

পূজ্য গুরুদেব শ্রী হিত গোবিন্দ স্মরণ মহারাজ সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে লয়ে বেড়ানো সন্তদের মধ্যে অন্যতম একজন সাধু ছিলেন। তিনি প্রেমানন্দ মহারাজকে সহচরী ভাব এবং নিত্য বিহার রসে দীক্ষিত করেন।

প্রেমানন্দ মহারাজ তার গুরুদেবকে একনিষ্ঠভাবে টানা ১০ বছর যাবৎ সেবা করেন এবং তাঁর আশীর্বাদ, স্নেহ এবং অনুগ্রহ কৃপায় বৃন্দাবন ধামের অপার মহিমায় মহারাজ, রাধারাণীর চরণপদ্মে রাধারাণীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে সক্ষম হন।

প্রেমানন্দ মহারাজের প্রবচন (Premenand Maharaj Pravachan)

প্রেমানন্দ মহারাজ তার কঠিন সাধনার দ্বারা উপলব্ধি করা জ্ঞান প্রেমানন্দ মহারাজ প্রবচন মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেন। তিনি তারা উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে ঈশ্বরের সানিধ্যে আসার প্রেরণা যোগায়। মহারাজের মতানুযায়ী মানুষ তার কর্মনুসারে ফল ভোগ করে।

ভাল কর্মের মাধ্যমে মানুষ পুণ্য অর্জন করে এবং খারাপ কর্মের মাধ্যমে মানুষ পাপ সঞ্চয় করে। তাই মানুষকে খারাপ কর্মের ফল যুগের পর যুগ ভোগ করতে হয়। তাই কর্মফলের এই বেড়াজাল থেকে একমাত্র মুক্তির উপায় হল প্রভুর নাম জপ করা এবং প্রভুর প্রতি অনুগত হওয়া।

ভগবানের প্রাপ্তি কীভাবে হয়

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী লিখনীতে এখন আপনাদের সামনে ভগবানের প্রাপ্তি কীভাবে হয় ? এই বিষয়ে মহারাজের ব্যক্তিগত অনুভূতি আপনাদের সাথে শেয়ার করব। প্রেমানন্দ মহারাজ বলেছেন যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের মন থেকে অন্যের প্রতি

ঈর্ষা,ক্লেশ,অসৎভাবনা ইত্যাদি দূর হবেনা, ততদিদন আমাদের পক্ষে ভগবৎ প্রাপ্তি সম্ভব নয়। আমরা যদি মনোযোগ সহকারে সৎসঙ্গ শুনি এবং সেগুলো যদি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে পালন করি তাহলে খুব সহজেই আমাদের ভগবৎ প্রাপ্তি সম্ভব।

ভগবানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভগবানের গুনগান করেও ভগবৎ প্রাপ্তি সম্ভব। জগৎ সংসারে ভগবৎ প্রাপ্তি করার এমন উত্তম ও সরল মার্গ আরো কোনো উপায়ে সম্ভাব্য নেই। ভগবৎ প্রাপ্তির সবথেকে সরল এবং উত্তম উপায় হল ভগবানের গুনকীর্ত্তন করা।

কবি তুলসী দাস বলেন –

” ছোট ভগতি মম গুন গণ, করি কপট তজি গান। “

আমাদের প্রত্যেককেই মনের ছলনা বাসনা ও কপটতা দূর করে কেবল ভগবানকে সন্তস্ট করার জন্যে ভগবানের গুনগান করা উচিত। কারণ ভগবানের কৃপাতেই আমাদের জন্ম হয়েছে আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি ।

আমরা যে দশাতেই থাকিনা কেন,আমরা গৃহস্থ জীবন যাপন করি আর সন্যাস জীবন যাপন করি, ভগবানের তাতে কিছু যায় আসেনা। আমরা সকলেই প্রভুর সন্তান, তাই আমাদের প্রত্যেকেরই ভগবানের গুনগান করা উচিত।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (Premanand Maharaj jiboni bangla)

আমরা যদি এই গুণকীর্ত্তনের মাধ্যমে ভগবানকে মানিয়ে নিতে পারি তাহলে আমাদের জীবন ধন্য হয়ে যাবে। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত ভগবানকে মানিয়ে রাখা, ভগবানকে রুষ্ঠ করা নয় !

মহারাজের বিশ্বাস একবার প্রভুকে মানিয়ে নিতে পারলে, পুরো দুনিয়া তোমার অধীন হয়ে যাবে। কারণ সংসারের সমস্ত বৈভবের মায়া ভগবানের দ্বারাই সৃষ্টি করা। আমরা সকলেই ঈশ্বরের সন্তান।

পিতার সম্পত্তিতে যেমন পুত্রের সম্পূর্ন অধিকার থাকে। তাই যে ভক্তের ভক্তি যদি সেই স্তরে পৌঁছে যায়, তাহলে তার মধ্যে অনন্ত প্রভুর মত সামর্থ এসে যায়। আর সত্য কথা বলতে গেলে যে ভক্তের ভক্তি, ভক্তির চরম স্তরে পৌঁছে যায়,

বাস্তবে সে আর ভক্ত থাকেনা, তিনি শুধু ভক্ত হওয়ার অভিনয় করেন, বাস্তবে তিনি ভগবানই হন। ভগবানের এই লীলা খেলা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা সম্ভব নয়, ভগবানের এই লীলা বোঝা শুধু ভগবানের কৃপা হলেই সম্ভব।

প্রেমানন্দ মহারাজ একাদশীর ব্রত রাখেন না কেন

প্রেমানন্দ মহারাজ মহারানী নিকুঞ্জ এর উপাসনা করেন। নিকুঞ্জে রাধা চরণাবৃন্দই হল প্রধান। রাধাবল্লভ সম্প্রদায়ে দাসি ভাব ও সহচরী ভাবের উপাসনা করা হয়। প্রেমানন্দ মহারাজ শ্রী রাধারানীর দাস তিনি অষ্টপ্রহর রাধারাণীর সেবা করেন।

প্রেমানন্দ মহারাজ বলেন আমি কোনো সাধু বা সন্ত নয়। তাই আমার উপর শাস্ত্র ও গ্রন্থের কোনো শাসন নেই। আমি শুধু বৃন্দাবনেশ্বরী, একজনেরই দাস। আর রাধাবল্লভ সম্প্রদায়ে রাধার দাসত্বভাবনায় প্রধান।

আমি আমার ইষ্ঠ দেবতার নাম প্রতিপলে জপ করি, নিয়মিত ভোগ অর্পণ করি। ভগবানকে উৎসর্গ করা সেই ভোগ আমি গ্রহণ করি। ভগবানের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত এক শীত প্রসাদ গ্রহণ করা মানে এক কোটি একাদশী ব্রত করার সমান ফল পাওয়া যায়।

”করে একাদশী মহাপ্রসাদ তে দূর , জমপুর বাঁধে একাদশী মহাপ্রসাদ সে দূর ,

জমপুর বাঁধে জায়েঙ্গে মুখ মে পড়ি য়হ ধুর। করি করি একাদশী মহাপ্রসাদ কো অংশ, ইনকো য়া পরতিতি হ্যা জিনকে হরিবংশ। .

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (Premanond Moharajer Jiboni Bangla)

হরিবংশের যুক্তি অনুসারে শ্রী রাধাবল্লভের ভোগ লাগানোর পর আপনি যদি মনে করেন, আজকে একাদশী সুতরাং আজকে আর অন্নের ভোগ গ্রহণ করবনা ,তাহলে একাদশীর পরের দিন হল দ্বাদশী। তাহলে দ্বাদশীর দিন ঐ ভোগের প্রসাদ কী করে খাবেন।

অন্ন তো আমরা প্রতিদিন খায় তবে ভগবানের নাম সেই অন্ন উৎসর্গ করলে সেই অন্ন আর অন্ন থাকেনা, সেই অন্ন প্রসাদ হয়ে যায়। রাধারাণীকে উৎসর্গকৃত রাধারাণীর অন্নের এঁঠো আমরা প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করি।

আর সেই অন্ন একাদশীর অন্ন হোক অন্য কোনো ব্রতের দিনের অন্ন হোক ভগবানকে যা কিছু উৎসর্গ করা হয় সেটাই ভগবানের প্রসাদ হয়ে যায়। আমরা যা কিছু খায় ভগবানকে নিবেদন করে খায়,

তাই সে একাদশীর অন্ন হোক কিংবা আর অন্য কোন দিনের অন্ন হোক, আমি অন্নকে অন্ন মনে করে গ্রহণ করিনা আমি অন্নকে ভগবানের প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করি। এখানে আপনারা বলবেন হয়ত একাদশীর দিন ভগবানের কাছে ফলের ভোগ লাগান।

এর প্রতিউত্তর হিসাবে মহারাজ বলেন আমি কেন শ্রী রাধার জন্যে ফলের ভোগ লাগাব। আমরা মনুষ্য সমাজ না হয় নিজেদের জন্যে ব্রত পালন করি কিন্তু শ্রী রাধা কেন আমাদের জন্যে কোন ব্রত পালন করবে এবং সে কেন ফলাহার গ্রহণ করতে যাবে ?

আমি নিত্যদিন আলাদা আলাদা ব্যঞ্জন তৈরী করে শ্রীমতি রাধার কাছে ভোগ নিবেদন করি। একইভাবে একাদশীর দিনেও শ্রীমতি রাধার জন্যে অন্নের ভোগই নিবেদন করি এবং শ্রীমতি রাধার খাবারের অবশিষ্ট্যাংশে স্বরূপ ভগবানের এঁঠো, প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করি।

ভগবানকে নিবেদন করা প্রতিটি ব্যাঞ্জনই হল আমার কাছে প্রসাদ স্বরূপ। ভগবানকে নিবেদন করা সেই প্রসাদ অন্নের হোক বা ফলের হোক ভক্তের কাছে ভগবানের এঁঠো মানেই সেটা হল ভগবানের প্রসাদ। আর সেই জন্যে আমার কাছে একাদশী কেন, কোনো ব্রতেরই আলাদা করে কোনো মহিমা নেই।

আমার কাছে একটি ব্রতই মান্য –

”জ্ঞান ধর্ম ব্রত কর্ম ইতে সব ,কাহু মে নহি মোয় প্রণীতি।

রসিক অনন্য নিসান বজায়, এক শ্যাম শ্যাম পদ প্রীতি।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনি (Premanand Maharj Biography Bangla)

এই কারণের জন্যে যদি গ্রহণও হয় তবুও আমাদের “টাটিয়া স্থানে” সারি লেগেই থাকে। কেননা আমার সনাতন ধর্মের কোনো উপাসনা নেই, আমার শুধু একটাই উপাসনা শ্রী রাধারাণীর প্রেমরসের উপাসনা।

আমি শুধু শ্রী রাধারাণীর অধীন,তাই আমার আলাদা করে ব্রত বা কোনো শক্তির আরাধনা করার প্রয়োজন হয়না। শ্রীমতি রাধারানীই হল আমার ইষ্ঠ। আমি হলাম শ্রীমতি রাধারাণীর দাস।

অবশ্যই পড়ুন : শিবরাত্রি কেন পালন করা হয়।

প্রেমানন্দ মহারাজের অহংকারের পতন

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনীতে (Premanand Maharaj jiboni bangla) অনেক শিক্ষণীয় ছোট বড় ছোট গল্প আছে যেগুলো আমাদের কাছে শিক্ষণীয়। একবার প্রেমানন্দ মহারাজ তার গুরুদেবের সঙ্গে দণ্ডবতী পরিক্রমা করছিলেন।

কিছুক্ষন পর রাস্তার ক্লান্তি দূর করার জন্যে মহারাজের গুরুদেব বিশ্রাম করার জন্য এক গাছতলায় বসেন। এরপর গুরুদেব প্রেমানন্দ মহারাজকে নগর থেকে কিছু ভিক্ষাকরে আনার জন্যে বলেন।

প্রেমানন্দ মহারাজ একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন তাই তার মনে জাত পাতের ছোঁয়াছুঁয়ি ব্যাপারটা রয়েই গেছিল। হয়ত জেনেবুঝেই মহারাজের গুরুদেব মহারাজের মন থেকে জাতিভাবনার এই ক্লেশ দূর করার জন্যে মহারাজকে ভিক্ষার করার জন্যে বলেন।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী
প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (premanand maharaj jiboni wikipeidia bangla)

তার সঙ্গে মহারাজের গুরুদেব মহারাজকে নির্দেশ দেয় ভিক্ষাকরার সময় ব্রজবাসীদের কাছে যাতে জাতি ধর্ম জিজ্ঞেস না করা হয়। ব্রজবাসীরা ভিক্ষা হিসাবে যেটা দেবে সেটাই যেন গ্রহণ করা হয়। কারণ গুরুদেবের মতাদর্শনুযায়ী ব্রজে বাস করা ব্রজবাসীরা কেউ সামান্য মানুষ নয়,তারা সবাই ভগবানের পার্ষদ।

তাই ব্রজবাসীরা যদি ভিক্ষা হিসাবে তারা তাদের এঁঠো খাবারও যদি ভিক্ষা হিসাবে তুলে দেয় তাতেই মানব সমাজের কল্যাণ হয়ে যাবে। এরপর গুরুদেবের আদেশকে মাথায় করে প্রেমানন্দ মহারাজ ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে করে ব্রজের উদ্দেশ্যে ভিক্ষা আনার জন্যে যায়।

ব্রজে গিয়ে তিনি একজন মহিলার কাছে ভিক্ষা চান, তখন সেই মহিলা মহারাজকে পেঁয়াজের চাটনি সহ একটি রুটি ভিক্ষা হিসাবে মহারাজের হাতে তুলে দেন। তখনি ঐ ঘর থেকে হঠাৎ একটি শুয়োর বেরিয়ে আসে, কেননা মহিলাটি তার ঘরে শুয়োর প্রতিপালন করে রেখেছিল।

এইসব দেখে মহারাজের গা ঘিন ঘিন করে ওঠে এবং তিনি গুরু মহারাজের কাছে এসে সমস্ত কিছু খুলে বলেন। মহারাজ তার গুরুদেবকে বলেন গুরুদেব আমি যার ঘর থেকে এই রুটি ভিক্ষা করে নিয়ে এসেছি তিনি হলেন নিচু জাতির লোক। মহিলাটি তার ঘরে শুয়োর পালন করে রেখেছিল।

গুরুদেব মহারাজের কাছে সমস্ত কিছু শুনে, নম্রতার সাথে বলেন নিচু জাতি হল তাতে কী হয়েছে রুটির মধ্যে লেগে থাকা পেঁয়াজের চাটনিটুকুকে হ্যান্ড পাম্পের জলে ধুয়ে নিয়ে এস, এরপর এই রুটি থেকে তুমি অর্ধেকটা নাও আর আমাকে অর্ধেকটা দাও।

গুরুদেবের কাছ থেকে মহারাজ এমন কথা শুনে আশ্চর্য্যচকিত হয়ে যান এবং তার মনে জমে থাকা উঁচু, নিচু জাত পাতের সমস্ত ধরণের বিচারধারা নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

সাচ্চা দেহাভিমান কে নাশ ব্রিজবাসিয়ো কী গালি খানে সে অর উনকি ঝুঠন খানে সে হি হোতা হ্যায়।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (premanand maharj jiboni bangla)

বৃন্দাবনের ভিতরে ব্রজবাসীদের কাছে গিয়ে ভিক্ষা নেওয়ার এটাই হল মুখ্য কারণ। বৃন্দাবন বাসীদের এতে কোনো পাপ হয়না কারণ তারা হল সকলেই ভগবানের পার্ষদ।

প্রেমানন্দ মহারাজের কিডনি রোগ

আমরা এখন প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনীতে প্রেমানন্দ মহারাজের শারীরিক স্থিতীর কথা তুলে ধরব। আপনারা জানেন হয়ত প্রেমানন্দ মহারাজের দুটো কিডনি বিগত ১০-১৫ বছর আগে থেকে গম্ভীর রোগে নষ্ট হয়ে গেছে।

মহারাজের কিডনি দুটি পলিস্টিক কিডনি রোগে আক্রান্ত ইংরেজীতে এই রোগকে Polycystic Kidney Disease বলে যার শর্ট ফর্ম হল PKD, যেটা কিডনীর একটি বংশানুগত জিনেটিক রোগ। এই ধরণের কিডনির রোগ সাধারণত বাবা-মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যে এসে যায়।

এই রোগের ফলে সাধারণত কিডনির উপরের অংশে সিস্ট তৈরী হয়ে যায় যা মূলত তরল রসে ভরা থাকে। কিডনির মধ্যে হওয়া সেই সিস্ট ছোট ও বড় উভয় ধরণের হয়। তবে এই রোগের ফলে কিডনিতে অজস্র এবং লক্ষ লক্ষ সিস্টের জন্ম হতে পারে।

অনেক সময় রোগীর স্থিতি গম্ভীর হয়ে গেলে এই ধরণের সিস্ট কিডনির উপরে সীমাবদ্ধ না থেকে কিডনির ভিতরের অংশেও শেকড় গাড়তে পারে। এই রোগের যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না যায় তাহলে সময়ের সাথে সাথে কিডনির দৈর্ঘ্য বাড়তেই থাকে।

যার ফলে কিডনি পুরোপুরিভাবে খারাপ হয়ে যেতে পারে, এমনকি কিডনি ফেটে যাওয়ার ভয় থাকে। কিডনির এই জটিল রোগ বংশানুক্রমে বাবা ও মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যে ছড়ায়, তবে এই রোগের প্রতিক্রিয়া (লক্ষণ) ৩০-৩৫ বছরের পর শরীরে চোখে পড়ে।

সাধারণত ৫৫-৬০ বছর বয়সে PKD রোগ শেষ পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, আবার কিছু লোক এতদিনও বাঁচেনা, ৩০-৩৫ বছরের মধ্যেই মারা যায়। এই ধরণের রোগের ফলে রোগীকে নানান ধরণের শারীরিক কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়।

তবে কিডনি ফেল হয়ে গেলে রোগীর শরীর পুরোপুরিভাবে ভেঙে যায় যার ফলে রোগীর এইসময় ডায়ালিসিস অথবা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার দরকার হয়। প্রেমানন্দ মহারাজের অনেক ভক্ত মহারাজকে কিডনি দেওয়ার জন্যে রাজী হলেও মহারাজ ভক্তদের থেকে কিডনি নিতে মানা করে দেন।

মহারাজের মতাদর্শনুযায়ী মহারাজ বলেন আমার কারো থেকে কিডনি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি পুরোপুরিভাবে সুস্থ। শরীরের যতদিন চলার ততদিন যেভাবে চলার হয় চলবে। তবে আমি কোনোমতেই অপরের শরীরকে কষ্ট দিয়ে তার পেট কেটে কিডনি নিতে পারবনা।

আমি আমার জীবন সমাজ কল্যানে মানুষের খুশির জন্যে উৎসর্গ করতে চায়। আমি আমার সুখের জন্যে কোনোমতেই অন্যব্যক্তিকে কষ্ট দিয়ে তার কিডনি গ্রহণ করতে পারবনা। এর থেকে তো আমার মরে যাওয়া ভাল।

এই রোগের বাহানায় আমি শ্রীমতি রাধারাণীর কাছ থেকে আদর পায়। আমার মনে হয় ভগবান আমার উপর কৃপা করে আমাকে এই রোগ দিয়েছে। আজ আমি নিজে এতটা অসহায় ঠিকই। কিন্তু আজ আমি জিবীত আছি সেটা রাধারাণীর কৃপাতেই।

যদি কোনো মানুষের কিডনি ফেল হয়ে যায় সেই ব্যাক্তি কি কখনো ভজন করতে পারে। কিন্তু আমি নিয়মিত ভজন করি এবং সৎসঙ্গ করি। এই সমস্ত কিছু কি রাধারাণীর কৃপা ছাড়া সম্ভব ! আমার যা কিছু সব কিছুই রাধারাণীর, রাধারাণীর কৃপা ছাড়া আমি সামর্থহীন মানুষ।

আজ রাধারাণীর কৃপাতেই আমি জীবিত আছি, আমাকে বাইরে থেকে দেখে আমার যে দুটি কিডনি খারাপ সেটা বোঝার উপায় নেই। অথচ আমার শরীরে ২৪ ঘন্টা ব্যাথা অনুভব হয় তবুও আমি সেই ব্যাথার বহিঃপ্রকাশ কখনই করিনা।

আমি আমার রোগের কথা জেনেও কখনো উদাস হয়ে থাকিনা। আমি সবসময় হাঁসিখুশীতে থাকার চেষ্টা করি। এই রোগা শরীরে প্রতিদিন রাধারাণীর সেবা করে রাত্রি ১১ টায় শুয়ে ভোর ০৩ টায় উঠে যায়।

আর যদি শক্তি ও সামর্থ্যের কথা বলেন আমি কোনোদিন নিজেকে দ্রুবল ভাবিনি। আজও আমার থেকে স্বাস্থ্যবান কোনো পুরুষকে কুস্তীর আখড়ায় ০২ মিনিটে আছাড় মেরে শায়েস্তা করতে পারি। এই সমস্ত কিছু রাধারাণীর কৃপা এবং সামর্থ ছাড়া সম্ভব নয়।

আমাকে যদি কোনো ভক্ত কিডনি দিতে চায়, তাতে আমার কোনো লাভ হবেনা, কেননা শ্রী রাধারানী যদি আমার হাত দিয়ে জাগতিক কল্যাণমূলক কার্য করতে চায় তাহলে আমার এই খারাপ কিডনি নিয়েও আমি বেঁচে থাকব।

তার জন্যে আলাদা করে আমার কোনো ভক্তের থেকে কিডনি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর যদি শ্রী রাধারানী আমাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চান তাহলে আমি লক্ষ কিডনি বদলি করে নিলেও আমার শরীরে প্রাণ থাকবেনা।

তার আদেশ মাত্রই এই শরীরের পরান পাখি নিমেষে উড়ে যাবে। তাই আমি এবং আমার ভক্তরা আমাকে তাদের কিডনি দিয়ে লক্ষ বার প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করলেও সমস্ত চেষ্টাই বিফল হবে। এই প্রাণ তুচ্ছ জগৎ ত্যাগ করে শ্রী রাধারাণীর দরবারে পারি দেবে, সেখানে কারো জাড়িজুড়ি চলবেনা।

আমার যখন ৩৫ বছর বয়স তখন আমার খুব পেট ব্যাথা হত। আমি আমার পেট ব্যাথা নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্যে যায়। সেখানে ডাক্তারবাবু বলেন রোগীর শরীরে রোগের কথা আমরা রোগীর পরিবারের সদস্যের সাথে শেয়ার করি।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী
প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (Premanand maharajer jiboni bangla)

কিন্তু বাবা তুমিতো এখানে একা চিকিৎসা করানোর জন্যে এসেছো, সাধু মানুষ তুমি, তোমার সাথে তোমার পরিজন কেউ নেই, তাই তোমার রোগের কথা তোমাকেই বলি। তোমার শরীরের মধ্যে থাকা ০২ টো কিডনি অর্ধেকের বেশি খারাপ হয়ে গেছে !

তাই আমার মনে হয় তুমি আর ০২ থেকে ০৩ বছর বা স্বর্বাধিক ০৫ বছর জীবিত থাকবে এর থেকে বেশি আর বাঁচাবেনা। মহারাজ তুমি ভজনকর্মের মধ্যে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকো তাই তোমাকে তোমার রোগের কথা জানালাম। এখন এর থেকে আমরা বেশি কিছু করতে পারবনা।

ডাক্তারের মুখে আমার রোগের কথা শুনে মনে হয় ভগবান হয়ত আমার জন্য এইরকমই কিছু লিখে রেখেছে। তাই আমি মনে মনে ইহ ধাম ত্যাগ করার জন্যে প্রস্তুতি শুরু করে দিই। এরপর আনন্দের সাথে পুরোদিন ভজন কীর্ত্তন করতাম।

কিন্তু আজ ভগবানের কৃপায় ১৮-১৯ বছর হয়ে গেছে আমার কিছুই হয়নি। তাহলে আপনারাই বলুন শ্রী রাধারাণীর কৃপা না থাকলে আমি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে এতদিন জীবিত আছি। শ্রী রাধারাণীর কৃপা না থাকলে কবে এই মেশিন বন্ধ হয়ে যেত, আর আমিও মরে যেতাম।

আমার দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালী দেখে অনেক সাধু মহন্তদের বিশ্বাসই হয়না যে আমি শুধুমাত্র ডায়ালিসিস করে জীবিত আছি। অনেক সাধু মহারাজ এমন আছেন যারা আমাকে একান্তভাবে প্রশ্ন করেন মহারাজ সত্যি সত্যিই কী আপনার দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে গেছে !

না আপনি জেনে বুঝে ভক্তদের কাছে কিডনি খারাপের নাটক করছেন। তখন আমি আমার পরনের কাপড় উঠিয়ে আমার ছাতিতে ঢোকানো ডায়ালিসিসের পাইপ দুখানা দেখায় তখন তারা ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন।

প্রেমানন্দ মহারাজ বলেন, না আমি আমার আয়ু দিয়ে বেঁচে আছি, না আমি আমার কিডনি দিয়ে বেঁচে আছি। আমি যদি বেঁচে আছি তো আমার রাধারাণীর কৃপায় বেঁচে আছি। সকল জীবের মরণ নিশ্চিত তাই যেদিন ডাক আসবে সেদিন সকলকেই ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করে যেতেই হবে।

আর যদি ঈশ্বরের ডাক না আসে তাহলে লক্ষ বার চেষ্টা করেও আপনার মরণ আসবেনা, আর আপনাকে চেষ্টা করেও কেউ মারতে পারবেনা। এই জগতের যা কিছু আমার সমস্ত রাধারাণীর কৃপাতেই।

প্রেমানন্দ মহারাজের চিকিৎসা কীভাবে হয়

প্রেমানন্দ মহারাজ বলেন আজ থেকে ১০ বছর আগে আমার এমন বেহাল দশা ছিল যে, আমি যা ভিক্ষা করে যা আনতাম, সেটাই আমি গ্রহণ করতাম। এমনও দিন ছিল যেদিন হয়ত ভীক্ষায় কিছু জুটতনা সেদিন অভুক্ত থেকেই দিন কাটাতাম।

সেই সময়ও আমার কিডনি খারাপ ছিল, কিডনি খারাপ হওয়ার জন্য প্রতিমাসে ১৬,০০ টাকার ওষুধ খেতে হত। তখনকার দিনে চারটি পরিবার এমন ছিল যারা নিয়মিত আমাকে টাকা পয়সা দিয়ে ওষুধ কিনতে সাহায্য করত, তাদের দেওয়া পয়সা দিয়েই আমি কিডনি খারাপের ওষুধ কিনতাম।

আমার দুটো কিডনিই খারাপ তাই আমাকে নিয়মিত কিডনি ডায়লাসিস করাতে হয়। যার জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকার দরকার হয়। এখন আপনারাই বলুন কারো কাছে টাকা সাহায্য চাইলে কে আমাকে রোজ রোজ এতো টাকা দেবে ?

একমাত্র শ্রী রাধারাণীর কৃপাতেই লক্ষ লক্ষ মানুষের সেবামনোভাবে সব ব্যবস্থা নিজে থেকেই হয়ে যায়। যখন আমি শুধু নিজের জন্যে চিন্তা করতাম, নিজের কথা ভাবতাম তখন আমাকে ভিক্ষা চাইতে হত।

কিন্তু যবে থেকে আমার সব কিছু রাধারাণীর চরণে অর্পণ করে দিয়েছি। তখন থেকে আমি নিজেকে একজন গরিব সাধু আর রাধারাণীর সেবক ছাড়া আর কিছুই মনে করিনা।

আর তখন থেকে ভগবানের কৃপায়, ভগবান তার সন্তান ভেবে আমার শয়ন, ভোজন, রোগ ব্যাধি চিকিৎসা আদির সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এইসব ভগবানের কৃপা ছাড়া সম্ভব নয়।

প্রেমানন্দ মহারাজকে যখন আশ্রম থেকে বার করে দেয়

মহারাজ বলেন আমি যখন কোনো আশ্রমে আশ্রয় নিতাম যেই তারা জানতে পারত মহারাজের দুটো কিডনি খারাপ, তখন তারা আমাকে নিয়ে চিন্তা করত মহারাজের চিকিৎসা করাতে হবে যার ফলে অনেক টাকা খরচ হবে।

মহারাজ যদি এখানে মারা যায় তাহলে কী হবে ? এইভেবে তারা আমাকে আশ্রম থেকে বার করে দিত। আমিও ধরে নিতাম এই দুনিয়ায় আমারতো কেউ নেই, তাই আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করা হচ্ছে।

আপনারা আজ আমাকে যেভাবে দেখতে পারছেন সমস্ত কিছুই রাধারাণীর কৃপাতেই। আমার এতে এক টাকাও নেই। এই বৃন্দাবনে আমি কতদিন ঠান্ডায় পাট দিয়ে তৈরী চটের বস্তা সেলাই করে গায়ে দিয়ে কত শীতের রাত কাটিয়েছি।

আমার এমন দশা ছিল একদিন যে আমার কাছে কিছুই ছিলনা। আমার যদি ০৫ টাকার দরকার হত তাহলেও কোনো ব্যক্তির পানে চেয়ে ভিক্ষা পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হত। আজও যদি আমার একইরকম হাল থাকত তাহলে হয়ত কোনো গাছ তলায় পড়ে পড়ে পচতাম।

তাহলে আপনারাই বলুন রাধারানী কৃপা না করলে আমি আজকে এই জায়গায় আসতে পারতাম। আজ ওনার কৃপাতেই আমার সব কিছু হয়েছে। সামান্য দৃষ্টিতে আপনাদের কাছে সব কিছু ম্যাজিক বলে মনে হবে।

এই আশ্রমে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ লোকের অন্নসেবা, রাজভোগ, শয়নের ব্যবস্থা, সাফ-সাফাই, ইলেকট্রিকের ব্যৱস্থা করা এর সব কিছু রাধারাণীর কৃপাতে আপনা আপনি নিজে থেকেই হচ্ছে।

এই আশ্রমে কারো কোনো চিন্তা নেই কোথা থেকে রেশন আসছে, কোথা থেকে দুধ আসছে, কোথা থেকে ওষুধ আসছে, ব্যাস সময়ের সাথে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে হয়ে যাচ্ছে। এখানে কারো কোনো চিন্তা নেই সব কিছু রাধারানী ব্যবস্থা করছে।

আমি যখন ১৩ বছর বয়সে ঘর ত্যাগ করছিলাম তখন আমি একা ছিলাম, আমার নিজের বলে কেউ ছিলনা। আজকে বর্তমানে আশ্রমের সমস্ত যুবক এবং স্মরণাগতরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে তারা সবাই আমাকে মাথায় করে রাখতে চায়।

তাদের মধ্যে আমায় কেউ যদি জল পান করায়, তো আবার কেউ আমার রুমাল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়। আবার কেউ পাখা করে বাতাস করতে চায়। এই সব ভগবানের কৃপা ছাড়া সম্ভব নয়। ভগবান মানুষের মধ্যে থেকে বিভিন্ন রূপে এসে আদর করছে বলেই আমার জীবন চলছে।

সেই জন্যে আমাদের কখনো ভাবা উচিত নয় আমার কি হবে ? যে পরমপিতা আমার আজকের জন্যে অন্ন ব্যবস্থা করেছে, তিনি আমাদের কালকের জন্যেও ঠিক ব্যবস্থা করবেন।

য়ে রহস্য রঘুনাথ কো বেগ ন জানে কোয়।
জো জানে রঘুপত কৃপা , তো স্বপ্নেহু মোহ ন হই ।।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (Premanand Maharaj jiboni bangle)

এই হল সেই মর্ম, যা ব্রহ্মজ্ঞানীজন,সন্তজন, মহাত্মাগণ জানতে পারেন এবং তারা জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। আর সংসারী লোক এর ভাবার্থ জানতে না পেরে একে অপরের উপর লাঠি চালাচ্ছে তাদের মধ্যে কেউ বলছে আমার ভগবান সবথেকে বড়,আর তোমার ভগবান ছোট।

প্রেমানন্দ মহারাজের সঙ্গে একান্তিক বার্তালাপ

প্রেমানন্দ মহারাজ তার ভক্তদের সঙ্গে একান্তিক বার্তালাপ করে থাকেন, তবে তিনি তার জন্যে আলাদা করে কোনো টাকা পয়সা নেন না। আপনিও আপনার সমস্যার কথা একান্তিক বাৰ্তালাপের মাধ্যমে মহারাজের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন।

প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (Premanand Maharajer Jiboni Bangla)

মহারাজ তার ভক্তদের সুখ ও দুঃখের কথা বড়ই মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং জীবনের এই ঘুর্নিপথে হতাশাগ্রস্থ ভক্তদের নতুনভাবে পথ দেখানোর কাজ করেন। মহারাজের সঙ্গে একান্তভাবে কথা বলার জন্যে

কেউ যদি কোনো রকমের ফর্ম ভরানোর জন্যে বলেন অথবা কোনো ধরণের টাকা নেওয়া হয় তাহলে আপনি মহারাজকে এই ব্যাপারে সরাসরি নালিশ জানাতে পারেন। মহারাজ সেই অপরাধীকে সনাক্ত করে কঠিন দন্ড দেওয়ার বিধান করে থাকেন।

প্রেমানন্দ মহারাজের আশ্রমের ঠিকানা

শুরুরদিকে মহারাজ বৃন্দাবনে এসে নির্দিষ্ট কোনো থাকার জায়গা না থাকায় বৃন্দাবনের বহু জায়গায় থেকে শ্রী রাধারাণীর সেবা করেছেন। যেমন – মহারাজ বৃন্দাবনের সন্ত কলোনী, অচল বিহার, মদন ঢের কুটির, লাডলী কুঞ্জ,কালীদহ এবং রমন রেতির মত বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন।

কিন্তু আপনারা যদি কেউ শ্রী প্রেমানন্দ মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে চান তাহলে প্রেমানন্দ মহারাজের বর্তমান ঠিকানা হল- শ্রী হিত রাধে কেলি কুঞ্জ বৃন্দাবন পরিক্রমা মার্গ, বাড়হা ঘাট, ভক্তিবেদান্ত হসপিসের বিপরীতে, রাধারমণ কলোনি, বৃন্দাবন, উত্তর প্রদেশ -২৮১১২১ মহারাজের বর্তমান ঠিকানা।

পরিশিষ্ট

আমরা এতক্ষন প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী (Premanand Maharaj Biography Bangla) এবং তার জীবনের ছোট বড় ঘটনাগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। প্রেমানন্দ মহারাজ তার আশ্রমে আশা বহু দিকভ্রষ্ট মানুষের সমস্যার কথা শুনে

মানুষকে নতুন করে জীবন যাপন করার জন্যে আসার আলো দেখিয়ে মানুষের মনে হাঁসি ফোটাচ্ছে। আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমরা প্রেমানন্দ মহারাজকে চিনলেও তার জীবন বৃত্তান্ত বহু মানুষের জানা ছিলনা।

আশাকরি আপনারা আমাদের আর্টিকেলের মাধ্যমে প্রেমানন্দ মহারাজের জীবনী সমন্ধে জেনে কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন। আপনাদের কাছে আমাদের এই লেখা মূল্যবান মনে হলে সবার সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দেবেন। ধন্যবাদ।

5/5 - (3 votes)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here