মহানায়ক উত্তম কুমারের জীবনী (Mohanayak Uttam Kumarer Jiboni,wiki,bio Bangla)

বাংলা চলচিত্র জগতে মহানায়ক উত্তম কুমার হলেন একজন কিংবদন্তী নক্ষত্র। আজকে আমরা মহানায়ক উত্তম কুমারের জীবনী বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালি ও বাংলা সিনেমা জগতের,

সর্বকালের সেরা নায়ক উত্তম কুমারের জীবনী সম্পর্কে দু-চারটে কথা আপনাদের সম্মুখে তুলে ধরব। অভিনয় জগতে উত্তম কুমার এমন একজন কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন যে, আজও তিনি দর্শক হৃদয়ে তার নিজস্ব জায়গায় স্বমহিমায় রয়েছেন।

স্বাধীনতার পরে সবে বাংলা চলচিত্র একটু একটু করে সাজতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই সাদাকালো পর্দায় অভিনয়ের জাদু কাঠির পরশে বাংলা সিনেমার রঙিন উপন্যাসকে আলাদা মাত্রা দিয়ে সঠিক তালমাত্রায় পৌঁছে দেয় উত্তম কুমার।

তবে অভিনয়ের জগতে পা দিয়েই সফলতার মুখ দেখেনি উত্তম কুমার, শুরুর দিকে বেশ কয়েকটা ছবিতে নিরাশার পর অবশেষে বাংলা অভিনয় জগতে নতুন দিশা পায় উত্তম কুমার।

একে একে সুপার হিট বাংলা ছবি দিয়ে বাংলার তরুণীদের মনে স্বপ্নের রাজপুত্র হয়ে ওঠে উত্তম কুমার। বাংলা ছবিতে জনপ্রিয়তার নিরিখে বাংলা সিনেমার ম্যাটিনি আইডলের তকমা পায় উত্তম কুমার।

তখনকার দিনের তরুণীরা যেমন উত্তম কুমার নাম শুনেই মোহাচ্ছন্ন হত, ঠিক তেমনি আবার তরুণরা, উত্তম কুমারকে দেখে উত্তম কুমারের স্টাইলে হেয়ার স্টাইল,দাড়ি ও গোফ রাখত।

উত্তম কুমারের জীবনী (Uttam Kumarer Jiboni,Wiki,Bio Bangla)

একনজরে উত্তম কুমারের জীবনীর বিভিন্ন দিকগুলি-

আসল নাম অরুন কুমার চ্যাটার্জী
বাংলা সিনেমা জগতে প্রসিদ্ধি নাম উত্তম কুমার
জন্ম ১৯২৬ সালের ০৩ সেপ্টেম্বর
জন্মস্থান কলকাতার আহিরীটোলার মামার বাড়িতে
বাবার নাম সাতকড়ি চ্যাটার্জী
মায়ের নাম চপলা দেবী
ভাই বরুন কুমার এবং তরুণ কুমার
শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক (গ্রাজুয়েট অসম্পূর্ণ)
চলচিত্র জীবনে পদার্পন করেন ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ছায়াছবি দিয়ে
স্ত্রী গৌরী দেবী (১৯৪৩ সালে বিবাহ করেন)
পুত্র গৌতম চ্যাটার্জী
নাতি গৌরব চ্যাটার্জী
উত্তম কুমারের লেখা বই আমার আমি এবং হারানো দিন গুলো মোর (অসম্পূর্ণ)
প্রেমিকা সুপ্রিয়া দেবী (জীবনের শেষ ১৭ বছর তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে কাটান)
উত্তম কুমারের মৃত্যু ১৯৮০ সালের ২৪ শে জুলাই হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান
উত্তম কুমারের জীবনী

উত্তম কুমারের শৈশব ও শিক্ষাও বিবাহ জীবন (Uttam Kumar Childhood,Education)

১৯২৬ সালের ০৩ রা সেপ্টেম্বর উত্তম কুমার তার কলকাতার আহিরীটোলার মামার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তবে নায়ক হিসাবে তিনি উত্তম কুমার নামে খ্যাতি পেলেও, উত্তম কুমারের আসল নাম হল অরুন কুমার চ্যাটার্জী।

উত্তম কুমারের বাবা শ্রী সাতকড়ি চ্যাটার্জী কলকাতার মেট্রো সিনেমা হলে মেশিন অপারেটরের কাজ করতেন এবং তার সাথে সময় পেলে মাঝে মধ্যে নাট্য চর্চায় মন দিতেন।

মাতা চপলা দেবী ঘরের গৃহকর্মে একজন সাধারণ মহিলার ন্যায় সংসারের কাজ সামলাতেন । উত্তম কুমারের আরো দুজন ভাই ছিলেন, তাদের নাম হল বরুন কুমার এবং তরুণ কুমার চ্যাটার্জী।

উত্তম কুমার তার স্কুল শিক্ষা পুরো করলেও, স্নাতক পাস করে উঠতে পারেননি। উত্তম কুমার সাউথ সার্বানান স্কুল থেকে তার স্কুল জীবনের পঠন পাঠন শুরু করেন।

পরে বাণিজ্য বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করার জন্যে তিনি গোয়েঙ্কা কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পারিবারিক দুরবস্থার জন্যে তাকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে কেরানীর চাকুরী নিতে হয়।

১৯৪৩ সালে উত্তম কুমার গৌরী দেবীকে বিবাহ করেন এবং তাদের একটি পুত্র সন্তান হয়। উত্তম কুমারের পুত্র সন্তানের নাম হল গৌতম চ্যাটার্জী।

আজকে গৌতম চ্যাটার্জীর পুত্র উত্তম কুমারের নাতি গৌরব চ্যাটার্জীকে বাংলা সিরিয়ালের ছোট পর্দায় অনেক চরিত্রেই হয়ত আপনারা দেখে থাকবেন।

উত্তম কুমারের সিনেমা জীবন (Uttam Kumar Cinema Life)

মহানায়ক উত্তম কুমার ১৯৪৮ সালে নীতিন বসুর “দৃষ্টিদান” ছবি দিয়ে, অরুন কুমার নাম দিয়েই সিনেমা জগতে পা রাখেন। কিন্ত শুরুর দিকে উত্তম কুমার অভিনীত সিনেমা গুলো ফ্লপ হওয়ার কারণে,

তিনি দর্শকদের হৃদয়ে সেরকম জায়গা করে উঠতে পারেন নি। এর আগে অবশ্য “মায়াডোর” ছায়াছবিতে উত্তম কুমার অভিনয় করেন কিন্তু সেই ছায়াছবিটি মুক্তি পায়নি।

উত্তম কুমারের জীবনী
উত্তম কুমারের জীবনী (Uttam Kumarer JIboni)

তারপর একের পর এক সিনেমা ফ্লপ হওয়ার কারণে, ফ্লপ হিরোর তকমার এক ঘেয়েমি ভাব কাটিয়ে ওঠার জন্যে তিনি জীবনে নানাবিধ পরিবর্তন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে নিজের নাম পরিবর্তনের সিধান্ত নেন।

ফ্লপ ছবির নায়কের তকমা পাওয়া পিছুটান থেকে বার হয়ে আসার জন্যে তিনি ক্রমাগত জীবন সংগ্রামের সাথে নিজের নাম পাল্টে অরুন চ্যাটার্জী, অরুন কুমার চ্যাটার্জী, আবার কখনো উত্তম চ্যাটার্জী তো কখনো আবার উত্তম কুমার নাম রাখেন।

শেষমেস উত্তম কুমার নাম দিয়েই তিনি তার মাথায় লাগা ফ্লপ নায়কের কলঙ্কের দাগ মিটিয়ে নিজের নামের সাথে বাংলা সিনেমার উত্তম নাম দিয়েই প্রকৃত উত্তম নায়ক হয়ে ওঠেন।

উত্তমের অভিনয় প্রেম ও সিনেমায় অভিনয়ের পিছনে কিছু কারণ অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায় ! উত্তম কুমারের বাবা সাতকড়ি চ্যাটার্জী ছিলেন নাট্যপ্রেমী মানুষ, সেই সূত্র ধরেই হয়ত উত্তমের রক্তে অভিনয়ের রক্তবীজ হয়তো পুঞ্জীভূত হয়েছিল।

উত্তম কুমার সেকালীন কলকাতার লুনার ক্লাবের সদস্য ছিলেন। সেই ক্লাবেই তিনি “মুকুট” নামক রবীন্দ্র নাটকে প্রথম মঞ্চাভিনয় দিয়ে অভিনয়ে হাতেখড়ি দেন।

এছাড়াও অভিনয়ের পাশাপাশি উত্তম কুমার সাঁতার কাটতেন, ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন। মল্লযুদ্ধের আখড়ায় ননী ঘোষের কাছে তিনি কুস্তির তালিম নিয়েছিলেন।

উত্তম কুমার ছিলেন একজন স্বাস্থবান পুরুষ, তাই অভিনয়ের পাশাপাশি তার রূপ সৌন্দর্যের জাদুও সেকেলের তরুণীদের মনে আঁচড় কাটত, বলা বাহুল্য সেকালের তরুণ প্রজন্ম উত্তম নামেই মোহো মুগ্ধ ছিলেন।

বিভিন্ন নায়িকাদের সাথে জুটি বেঁধে উত্তম কুমারের উত্থান

একের পর এক উত্তম অভিনীত ছায়াছবি গুলো ফ্লপ হয়ে যাওয়ায় উত্তম কুমার মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। সেই সময় অবশ্য উত্তম কুমারের স্ত্রী (প্রেমিকা) সুপ্রিয়া দেবী উত্তম কুমারের পাশে ছিলেন।

স্ত্রী (প্রেমিকা) সুপ্রিয়া দেবীর অনুপ্রেরণায় উত্তম কুমার আবার নতুন করে সিনেমায় অভিনয় শুরু করলেন। সেই সময় সেকালের সেরা এম.পি. স্টুডিওর সাথে তিনি অবশ্য তিন বছরের জন্যে চুক্তি আবদ্ধ হন।

এম.পি. স্টুডিওর দৌলতে তিনি ‘বসু পরিবার’ নামে একটি ছায়াছবিতে অভিনয় করলেন। ছবিটি দর্শকদের আসর জোগাল। উত্তম কুমার ভাঙা মনে সাহস ফিরে পেলেন। এরপর তিনি সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বাঁধলেন-

উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন জুটি

১৯৫৩ সালে উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে “সাড়ে চুয়াত্তর” ছবিতে অভিনয় করলেন। সিনেমাটি মুক্তি পেতেই প্রেক্ষাগৃহে ব্লকব্লাস্টার হয়ে যায়। এক টানা ৬৫ সপ্তাহ ধরে সিনেমা হলে দর্শকদের মন যোগায় উত্তম সুচিত্রার সাড়ে চুয়াত্তর।

এরপর উত্তম কুমারকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়না, উত্তম ও সুচিত্রা জুটি একের পর এক সুপারহিট সিনেমা দিয়ে দর্শকদের মন জোগাতে থাকে।

সব মিলিয়ে ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত টানা এক বছর উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন একসাথে অভিনয় করেন। উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ৩০+ সিনেমা রয়েছে। উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমা গুলো হল-

অগ্নিপরীক্ষা,শাপমোচন,ইন্দ্রানী,সপ্তপদী,হারানো সুর,প্রিয় বান্ধবী ইত্যাদি। এই সমস্ত সিনেমা গুলোই তৎকালীন বাংলা সিনেমার সাদাকালো পর্দাকে একটানা প্রায় ২০ বছর যাবৎ ভালোবাসার খোরাক হিসাবে সেরা সিনেমার শিরোপাই সাজিয়ে রেখেছিল।

উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া চৌধুরী জুটি

উত্তম ও সুচিত্রা জুটির পর দর্শকদের মন কেড়েছিল উত্তম ও সুপ্রিয়া চৌধুরীর জুটি। উত্তম ও সুপ্রিয়া দেবীর বড় পর্দায় তাদের পথচলা শুরু হয় “সোনার হরিণ” ছায়াছবি দিয়ে। এরপর একে একে উত্তম ও সুপ্রিয়া দেবীর জুটি

সময়ের সাথে সাথে বহুবিধ সিনেমা উপহার দিয়ে দর্শকদের মন জুগিয়েছেন। উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবী অভিনীত সেরা সিনেমা গুলো হল- সোনার হরিণ, সন্যাসী রাজা,বন পলাসীর পদাবলী,বাঘ বন্দীর খেলা ইত্যাদি।

অভিনয় জগতের বাইরে সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমারের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি জীবনদশায় শেষের ১৭ টা বছর স্ত্রী গৌরী দেবীকে ত্যাগ করে সুপ্রিয়া দেবীর সাথেই কাটিয়েছিলেন।

একইভাবে সুপ্রিয়া দেবীও উত্তমের প্রেমে নিজের স্বামীকে পাকাপাকিভাবে ছেড়ে দিয়ে, উত্তম কুমারকে নিজের সেবা যত্ন দিয়ে নিজের প্রাণের দোসর হিসাবেই ভালোবাসার খোরাক জুগিয়েছিলেন।

উত্তম কুমার ও সাবিত্রী দেবীর জুটি

উত্তম সুচিত্রা ও উত্তম সুপ্রিয়া জুটি ছাড়াও আর একটি বেশ জনপ্রিয় জুটি হল উত্তম সাবিত্রী জুটি। উত্তম কুমার ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে বেশ কয়েকটি ছায়াছবিতে একসঙ্গে দেখা গেছে।

উত্তম কুমার অবশ্য সাবিত্রী দেবীকে একজন প্রতিভাশালী অভিনেত্রী বলে মনে করতেন। উত্তম কুমার ও সাবিত্রী দেবীর কত গুলো উল্লেখযোগ্য সিনেমা হল- হাত বাড়ালেই বন্ধু,মৌচাক, ধন্যি মেয়ে ইত্যাদি।

তবে উত্তম কুমার ও সাবিত্রী দেবী অভিনীত হাস্যকৌতুক সংলাপ দ্বারা নির্মিত বাংলা সিনেমা “মৌচাক” আজও দর্শকদের কাছে সমান আদরের।

মহানায়ক উত্তম কুমার

উত্তম কুমার সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবিত্রী দেবী ছাড়াও শর্মিলা ঠাকুর,মাধবী মুখার্জী,তনুজা,অঞ্জনা ভৌমিকের সাথে বেশ কয়েকটি ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন।

উত্তম কুমার অভিনীত আরো অন্যান্য সিনেমা গুলো হল- ভ্রান্তি বিলাস, এখানে পিঞ্জর, গৃহদাহ, জুতুগৃহ,মায়ামৃগ, মরুতীর্থ হিংলাজ, আনন্দ আশ্রম ইত্যাদি।

উত্তম কুমারের জীবনী
উত্তম কুমারের জীবনী (Uttam Kumarer Jiboni)

এই সমস্ত ছায়াছবির বাইরে উত্তম কুমার সর্বকালের সেরা চিত্রপ্রযোজক সত্যজিৎ রায় প্রযোজিত, দুটি বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায় প্রযোজিত উত্তম কুমার অভিনীত সিনেমা দুটি হল- চিড়িয়াখানা ও এন্টোনি ফিরিঙ্গি।

এই ছবি দুটির দৌলতে উত্তম কুমার ১৯৬৭ সালে “সেরা অভিনেতা” হিসাবে জাতীয় পুরুস্কার পান। বাংলা সিনেমা জগতে উত্তম কুমারই ছিলেন “সেরা অভিনেতা” জাতীয় পুরুস্কার বিজেতা বাংলা সিনেমার প্রথম নায়ক।

বাংলা ও হিন্দি সহ সব মিলিয়ে উত্তম কুমার প্রায় ২৫০ + ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন। তারজন্যে উত্তম কুমারকে ভারত সরকার ১৯৭৫ সালে ২৫ শে নভেম্বর “মহানায়ক” পুরুস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন।

কলকাতার টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনটি উত্তম কুমারকে সম্মান জানিয়ে তার নামে মেট্রো স্টেশনটির নাম রাখা হয় মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন।

অভিনয়ের বাইরে উত্তম কুমারকে চিত্রপ্রযোজক এবং সংগীত পরিচালকের ভূমিকাতেও দেখতে পাওয়া যায়। উত্তম কুমার তার অভিনয় জীবনের বাইরে চিত্র প্রযোজনার কাজও করেছেন।

বন পলাশীর পদাবলী এবং শুধু একটি বছর ছায়াছবিতে তিনি চিত্রপ্রযোজনার কাজ করেন। চিত্রপ্রযোজনার পাশাপাশি উত্তম কুমারকে সংগীত পরিচালনার কাজেও আমরা দেখতে পায়।

‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবিতে উত্তম কুমার নিজে সংগীত পরিচালনার কাজ করেছিলেন। এই ছায়াছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সুর সম্রাগী লতা মঙ্গেস্করকে একসঙ্গে যৌথ কণ্ঠে গান গাইতে দেখা যায়।

১৯৮০ এর দশকে উত্তম কুমার একটি আত্মজীবনী মূলক “আমার আমি” বই লেখেন, এই বইটি অবশ্য প্রকাশ পায়। কিন্তু উত্তম কুমারের আরও একটি আত্মজীবনী মূলক বই “হারানো দিনগুলি মোর”,

এই বইটি তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি,তার আগেই উত্তম কুমার হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী মূলক অসম্পূর্ন “হারানো দিনগুলি মোর” বইটি ৩৭তম কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়।

বাঙালির মনে জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির শিখরে থাকা উত্তম কুমারকে একবার অল ইন্ডিয়া রেডিওর পক্ষ থেকে মহালয়া পাঠ করার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু সেই বছর যদিও তিনি রেডিওতে মহালয়া পাঠ করেছিলেন

তবুও তিনি মহালয়ার সেরা বাক শিল্পী হিসাবে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের জনপ্রিয়তাকে উত্তম কুমার হার মানাতে পারেনি। দর্শকগণ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রকেই মহালয়ার সেরা বাচক শিল্পী হিসাবে ভালোবাসা দেয়।

উত্তম কুমারের হিন্দি সিনেমা

বাংলা সিনেমার বাইরে উত্তম কুমারকে বেশ কয়েকটি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করতে দেখতে পাওয়া যায়। উত্তম কুমার বলিউডে বৈজয়ন্তী বালার সঙ্গে “ছোটি সি মুলাকাত”,এছাড়া আনন্দ আশ্রম,

অমানুষ, কিতাব, দুরিয়া ইত্যাদি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেন। কিন্ত এই সমস্ত সিনেমা গুলো মুম্বাইয়ে হিন্দি সিনেমার দর্শকদের মনে সেরকম সাড়া ফেলতে পারেননি,তাই তিনি বাংলা সিনেমার জগতে টলিউডে ফিরে আসেন।

উত্তম কুমারের সিনেমার তালিকা

উত্তম কুমারের জীবনী অধ্যয়ন করলে দেখতে পাওয়া যায়, উত্তম কুমার তার জীবন দশায় ২৫০ এর বেশি চলচিত্রে অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমার অভিনীত সিনেমার তালিকা আপনাদের সামনে একনজরে তুলে ধরা হল-

সাল সিনেমা
১৯৪৮দৃষ্টিদান
১৯৪৯কামনা
১৯৫০মর্যাদা
১৯৫১সহযাত্রী, নষ্টনীড়, ওরে যাত্রী
১৯৫২সঞ্জীবনী,বসু পরিবার, কার পাপে
১৯৫৩সাড়ে চুয়াত্তর, লাখ টাকা, নবীন যাত্রা,বৌ ঠাকুরানীর হাত
১৯৫৪মরণের পরে, ওরা থাকে ওধারে, চম্পাডাঙ্গার বৌ,অন্নপূর্ণা মন্দির,অগ্নি পরীক্ষা,মনের ময়ূর,গৃহপ্রবেশ,বকুল,মন্ত্র শক্তি,কল্যাণী,ব্রতচারিনী,সদানন্দের মেলা,বিধিলিপি,অনুপমা
১৯৫৫উপহার,কঙ্কাবতীর ঘাট,রাইকমল,দেবতা,সাঁঝের প্রদীপ,হ্রদ,শাপ মোচন,
১৯৫৬ ত্রিজামা,শ্যামলী,শিল্পী,শঙ্কর নারায়ণ,ব্যাঙ্ক,সাহেব-বিবি-গোলাম,সাগরিকা,পুত্রবধূ,নবজন্ম, লক্ষ-হীরা,একটি রাত,চিরকুমার সভা,রাত ভোর
১৯৫৭ সুরের পরশে,পূর্ণ মিলন,পৃথিবী আমারে,চায়,পথে হল দেরী,হারানো সুর,চন্দ্রনাথ,বড়দিদি,যাত্রা হল শুরু,তাসের ঘর,অভয়ের বিয়ে,হার জিত,জীবন তৃষ্ণা
১৯৫৮সূর্যতোরণ,স্কুল,ইন্দ্রানী,ডাক্তার বাবু,রাজলক্ষী ও,শ্রীকান্ত,যৌতুক,বন্ধু,শিকার
১৯৫৯মরুতীর্থ হিংলাজ,খেলাঘর,গলি থেকে রাজপথ,চাওয়া পাওয়া,বিচারক,সোনার হরিণ,পুষ্পধনু,অবাক পৃথিবী
১৯৬০শুনো বড়নারী,রাজা-সাজা,মায়া মৃগ,কুহক,হাত বাড়ালেই,বন্ধু,খোকা বাবুর,প্রত্যাবর্তন,সখের চোর,উত্তর মেঘ,শহররে ইতিকথা
১৯৬১সাথীহারা,সপ্তপদী,দুই ভাই,ঝিন্দের বন্দি,অগ্নিসংস্কার,নেকলেস
১৯৬২কান্না,বিপাশা,শিউলিবাড়ি,আমার দেশ
১৯৬৩উত্তরায়ণ,সূর্য শিখা,শেষ অঙ্ক,ভ্রান্তি বিলাস,দেয়া নেয়া,নিশীথে,উত্তর ফাল্গুনী,বিন বাদল বার্সাত
১৯৬৪মোমের আলো,লাল পাথর,যৌতুগৃহ,বিভাস,নতুন তীর্থ
১৯৬৫সূর্য তাপ, থানা থেকে, আসছি,রাজকন্যা,দো-দিল,
১৯৬৬রাজদ্রোহী,শুধু একটি,বছর,নায়ক,কাল তুলে আলেয়া,শঙ্খবেলা
১৯৬৭নায়িকা সংবাদ,চিড়িয়াখানা,ছোটি সি মুলাকাত,এন্টোনি ফিরিঙ্গি,জীবন মৃত্যু,গৃহদাহ
১৯৬৮তিন অধ্যায়,কখনো মেঘ,গড় নাসিমপুর,চৌরঙ্গী
১৯৬৯চিরদিনের,অপরিচিত,কমললতা,সাবরমতি,মন নিয়ে,শুকসারি,
১৯৭০মঞ্জরী অপেরা,কলঙ্কিত নায়ক,নিশি পদ্ম,বিলম্বিত লয়,দুটি মন,রাজ কুমারী
১৯৭১ধন্যি মেয়ে,ছদ্মবেশী,এল আমার আলো,জয়জয়ন্তী,এখানে পিঞ্জর,জীবন জিজ্ঞাসা,নবরাগ
১৯৭২স্ত্রী, হার মানা হার,মেম সাহেব,অন্ধ অতীত,বিরাজ বৌ,ছিন্নপত্র
১৯৭৩সোনার খাঁচা,কায়াহীনের কাহিনী,বনপলাশীর,পদাবলী,রুদ্র ছায়া, রাতের রজনীগন্ধা
১৯৭৪যদু বংশ,আলোর ঠিকানা, যদি জানতেন,অমানুষ,বিকেলে ভোরের ফুল,রক্ত তিলক,রোদন ভরা,বসন্ত
১৯৭৫সন্যাসী রাজা, অগ্নিস্বর,মৌচাক,কাজল লতা,আমি সেও সখা,নগর দর্পন,প্রিয় বান্ধবী,বাগবান্দীর খেলা
১৯৭৬সেই চোখ, বহ্নি শিখা,নিধিরাম সর্দার,হোটেল স্নো ফক্স,আনন্দ মেলা,মোমবাতি,চাঁদের,কাছাকাছি,
১৯৭৭আনন্দ আশ্রম,কিতাব,সব্যসাচী,রাজবংশ,ভোলা ময়রা,সিস্টার,অসাধারণ,জয় সন্যাসী
১৯৭৮দুই পুরুষ,বন্দি,নিশান,ধনরাজ তামাং
১৯৭৯শ্রীকান্তের উইল,দুরিয়া,দেবদাস,সমাধান,ব্রজবুলি,সুনয়নি, নব দিগন্ত
১৯৮০দুই পৃথিবী,রাজা সাহেব,পঙ্খিরাজ,আরো একজন,রাজ নন্দিনী,দর্পচূর্ণ,সূর্য সাক্ষী,প্লট নং-০৫, ওগো বধূ সুন্দরী,কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী,খানা বরা,প্রতিশোধ,দেশ প্রেমী, ইমন কল্যাণ
উত্তম কুমারের জীবনী (Uttam Kumarer JIboni)

উত্তম কুমারের মৃত্যুর কারণ

জীবনের শেষের দিকে উত্তম কুমার নানা রকম মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, টালিগঞ্জের সিনেমা পাড়াও উত্তম কুমারকে ক্রমশ এড়িয়ে চলছিলেন।

কিন্ত সামনা সামনি উত্তম কুমারের মুখের সামনে সোজা সাপ্টা জবাব কেউই দিতে পারছিলেন না। উত্তম কুমার যে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি এমনটা নয়।

তবুও উত্তম কুমার সবটা বুঝেও টলিপাড়ায় শুটিং চালাচ্ছিলেন। অপরদিকে তার পত্নী সুপ্রিয়া দেবী হাসপাতালে ভর্তি, সবমিলিয়ে উত্তম কুমার চিন্তা গ্রস্থ ছিলেন।

১৯৮০ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর সেই রকম একটা দিন ছিল। প্রাতঃকালে স্নান করে, পূজা সেরে শুটিংয়ের জন্যে উত্তম কুমার বেরোচ্ছিলেন, শুটিংয়ে বেরোনোর আগে সুপ্রিয়া দেবী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উত্তম কুমারকে বিদায় জানাতেন।

উত্তম কুমারের গাড়ির গেট পর্যন্ত গিয়ে রাস্তা পেরোনো পর্যন্ত সুপ্রিয়া দেবী দাঁড়িয়ে থাকতেন। উত্তম কুমার গাড়ির জানালা দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন আজ কিন্তু উত্তম কুমার তার আদরের বেণুর (সুপ্রিয়া) দেখা পেলেন না।

স্ত্রী গৌরীর সঙ্গে ঝগড়া করে কলকাতার ময়রা স্ট্রিটের সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন উত্তম কুমার। উত্তম কুমার তার জীবনীতে বলেছিলেন “সেদিন বিস্ময় ও মমতা নিয়ে হাসি মুখে দরজা উন্মুক্ত করে আশ্রয় দিয়েছিলেন বেণু। “

তখন থেকে জীবনের শেষদিন টানা ১৭ বছর ময়রা স্ট্রীটের বাড়িতেই উত্তম বাবুর ঠিকানা হয়ে উঠেছিল। এমনি একদিন শুটিংয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়িতে উঠছিলেন,

এমন সময় দেখলেন গাড়িতে থাকা সুদীর্ঘ্য ১৭ বছরের সঙ্গী তার টেপ রেকর্ডারটা যথা স্থানে নেই। উত্তম কুমার তো হতভম্ব ! এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না, জিনিসটা উধাও কি করে হয়ে গেল ?

শেষে অবশ্য তার বুঝতে বাকি রইলনা তার প্রিয় টেপ রেকর্ডারটা চুরি হয়ে গেছে। উত্তম কুমার মনে মনে খুব বিস্বাদ গ্রস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন ঠিক যেন কোনো প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা।

সুখ ও দুঃখের টানা ১৭ বছরের সঙ্গী ছিল উত্তম কুমারের টেপ রেকর্ডারটা। এই টেপ রেকর্ডার টার সাথে উত্তম বাবুর নানা স্মৃতি জড়িত ছিল। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে এভাবেই তার স্মৃতি জড়িত টেপ রেকর্ডার টা ছেড়ে চলে যায়।

এত মন খারাপের মাঝেও সেদিন “ওগো বধূ সুন্দরী” ছবির শুটিং সেটে শুটিংয়ের জন্যে হাজির হয়েছেন, কিন্ত কেমন যেন অন্যমনস্ক ছিলেন উত্তম কুমার। সারাটা দিন সেরকম ভাবে খাওয়া দাওয়া করেননি উত্তম কুমার।

কিন্ত কেই বা জানত সেদিনই তার জীবনের শেষ দিন। সেদিনের শুটিংয়েই হতে চলেছে তার জীবনের শেষ সংলাপ, “আমিও দেখে নেবো, আমার নাম গগন সেন….” এই সংলাপ পুরো বলতে না বলতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন উত্তম কুমার।

অসুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরলেন উত্তম কুমার। বাড়ি ফিরেও বিছানায় বিশ্রাম নেননি উত্তম কুমার। উত্তম কুমারের বন্ধু দেবেশ ঘোষের কথা রেখে সেদিন তার বাড়িতে নেমন্তনে হাজির হন উত্তম কুমার।

বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে দিতে কখন মাঝ রাত্রি হয়ে গেছে, ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর পড়েনি কারো। অবশেষে রাত করেই মাঝ রাত্রে বাড়ি ফিরলেন উত্তম কুমার।

উত্তম কুমার বাড়ি ফিরে অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন, আবার অসুস্থ হলেন উত্তম কুমার। এরপর একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন উত্তম কুমার। চিকিৎসার জন্যে উত্তম কুমারকে একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়।

আইসিইউ তে ০৪-০৫ টা ডাক্তার নিরলস ভাবে চেষ্টা করেও, শেষ পর্যন্ত উত্তম কুমারকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না। ১৯৮০ সাল ২৪ শে জুলাই রাত ০৮ টা ৩২ মিনিটে

দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চকে হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। উত্তম কুমারের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি,

ততক্ষনে উত্তমের গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়িতে বিশিষ্ট জনেদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। উত্তমের মৃত্যুর খবর বেশিক্ষণ চাপা রাখা গেলোনা,

২৫ তারিখ ভোর বেলায় সে খবর কলকাতা মহানগর থেকে ছড়িয়ে ভূ-ভারতে উত্তম কুমারের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। ভক্তরা ভিড় করেছিল রাস্তায় রাস্তায় গুরুকে শেষ বারের মত দেখার জন্যে।

FAQ

প্রশ্ন- উত্তম কুমারের জন্মদিন কবে ?

উঃ- ১৯২৬ সালের ০৩ রা সেপ্টেম্বর।

প্রশ্ন- উত্তম কুমারের আসল নাম কি ?

উঃ- উত্তম কুমারের আসল নাম হল অরুণ কুমার চ্যাটার্জী।

প্রশ্ন- উত্তম কুমারের নাতির নাম কি ?

উঃ- উত্তম কুমারের নাম গৌরব চ্যাটার্জী।

প্রশ্ন- উত্তম কুমারের মৃত্যুর কারণ কি ?

উঃ- উত্তম কুমার হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

পরিশিষ্ট

উত্তম কুমারের মৃত্যুতে উত্তম কুমারের ভক্ত মহলে নেমে এলো শোকের ছায়া। গুরু গুরু বলে আফসোস করলেন সবাই। উত্তম কুমারের এভাবে অকাল মৃত্যুতে সত্যজিৎ রায় বলে বসলেন-

“উত্তমের মত কোনো নায়ক নেই, কেউ হবেও না। আশ্চর্য অভিনয় দক্ষতা উত্তমের। ওর ক্ষমতা আছে দর্শক টেনে রাখার…” শোকাচ্ছন্ন সুচিত্রা সেনের কথায়- ” সত্যি উত্তম হল Grate..তবুও যেন মনে হয়, ওকে ঠিক মতো আবিষ্কার করা গেলোনা।”

সবমিলিয়ে ২৫০ এর বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। বিভিন্ন সময়ে নানা বিধ চরিত্রে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছেন উত্তম কুমার, কখনো ভিখারি, আবার কখনো রাজা।

তবে কোথাও যেন বাঙালির মনে আজও উত্তমের সেলুলয়েড জীবনের কাহিনী আজও ধরা আছে। দেশ কালের বাইরে বহু নায়ক বহু বার জন্ম নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মহানায়ক একজনই রয়ে গেছেন, সে হল উত্তম কুমার।

4.3/5 - (7 votes)

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here