হিন্দু শাস্ত্র মতে বসন্ত পঞ্চমীর দিন সরস্বতী পূজা করা হয়। এবারে প্রশ্ন হল সরস্বতী পূজা কেন করা হয় অথাৎ আমরা সরস্বতী পূজা কেন করি ? হিন্দু ধর্মে বসন্ত পঞ্চমীকে শ্রীপঞ্চমী বলা হয়। হিন্দুদের শ্রীপঞ্চমী অথাৎ বসন্ত পঞ্চমীর দিন হল সরস্বতী পূজার দিন।
এই দিনেই নিয়ম বিধি মেনে হিন্দু ধর্মের মানুষেরা বিশেষ করে যারা শিক্ষা পেশা ও শিল্পকর্ম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, যেমন- স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টার থেকে শুরু করে গানের স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেই সরস্বতী পূজার চর্চাটা বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
তবে এই দিনটিকে শুধু বিদ্যার দেবী মা সরস্বতী আরাধনার দিন বললেও ভুল বলা হবে। কারণ এই দিনটিতে শিক্ষা দীক্ষার সাথে সাথে নতুন শিল্পকর্ম শুরু করার জন্যে শুভ দিন বলে মনে করা হয়।
কথিত আছে বসন্ত পঞ্চমীর দিনে কামদেব তার অর্ধাঙ্গিনী, রতি দেবীকে নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাই হিন্দু ধর্মের অনেক মানুষেরা বিশ্বাস করেন যাদের দাম্পত্য জীবন সুখের নয় সেই সমস্ত couple একসাথে বসন্ত পঞ্চমীতে কামদেব ও তার স্ত্রী রতির পূজা করলে দাম্পত্য জীবন সুখের হয়।
Table of Contents
বসন্ত পঞ্চমী কি- Basanta Panchami Ki
উপনিষদের কাহিনী অনুসারে সৃষ্টির শুরুতে ভগবান শিবের আজ্ঞা অনুসারে প্রজাপতি ব্রহ্মা পৃথিবীতে বিভিন্ন জীব জড় ও কীট পতঙ্গের সাথে সাথে মনুষ্য (মানুষ) যৌনির সৃষ্টি করেন। পৃথিবীতে জীবকুলের রচনা করেও ব্রহ্মা তার নিজের সৃষ্টির উপর সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না।
প্রজাপতি ব্রহ্মার সর্বদা মনে হচ্ছিল তার রচনার মধ্যে যেন তিনি কোনো ত্রুটি রেখেদিয়েছেন ? ব্রহ্মা তখন তার সৃষ্টকর্মের দ্বারা অনুশোচিত হয়ে হাতের তলে কুমণ্ডলের জল নিয়ে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে স্মৃতি চারণে সংকল্প শুরু করেন।
ব্রহ্মার স্মৃতিচারণ শুনে ভগবান বিষ্ণু (নারায়ণ) ব্রহ্মার সামনে প্রকট হলেন এবং ব্রহ্মার সমস্যার কথা জেনে ভগবান নারায়ণ আদিশক্তি মা দুর্গাকে আহ্ববান জানালেন। ভগবান নারায়ণের আহ্ববানে মা দূর্গা প্রকট হলেন।
তখন ব্রহ্মা বিষ্ণু উভয়ে মিলে দেবী দুর্গার কাছে তাদের সমস্যার কথা জানিয়ে সংকট মোচনের কথা বললেন। ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর কথা শুনে মা দূর্গা তার দৈবিক শরীরের তেজস্বীতায় দিব্য নারী রূপী এক দেবী তৈরী করলেন।
দেবীর চার হাত, দেবীর এক হাতে বীণা, দ্বিতীয় হাতে বর মুদ্রা এবং অপর দুইটি হাতে পুস্তক ও মালা। আদিশক্তি শ্রী দেবী দুর্গার শরীরের তেজস্বীতা রশ্মী থেকে স্বেত বর্ণের দেবী বীণা হাতে প্রকট হতেই, দেবীর হাতে বীণা মধুরনাদ করতে লাগল।

এতক্ষন যে পৃথিবী শান্ত ও নিশ্চল ছিল, দেবীর বীণার মধুরনাদে সমস্ত জীবকূলে বাণী প্রাপ্ত হল। জলাশয়ের জলধারা কলকল শব্দ করতে লাগল। আকাশে শনশন করে নির্মল বাতাস বইতে লাগল।
দেবীর মহিমায় মোহিত হয়ে তখন সমস্ত দেবী ও দেবতারা শব্দ এবং রসের সঞ্চার করা স্বেত বর্ণের দেবীর নাম দিলেন “দেবী সরস্বতী”. এরপর আদিশক্তি মা দূর্গা ব্রহ্মাকে বললেন আমার তেজে উৎপন্ন স্বেত বর্ণের দেবী সরস্বতী আপনার পত্নী হয়ে আপনার মধ্যে শক্তির সঞ্চার করবে।
যেমন- ভগবান নারায়ণের পত্নী স্বরূপ মা লক্ষী, মহাদেবের পত্নী মাতা পার্বতী যেমন ভগবান শিবের শক্তি যোগায়। তেমনি দেবী সরস্বতী ব্রহ্মা পত্নী হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মার শক্তি যোগাবে তথা স্বেতরূপী দেবী সরস্বতী –
“প্রনো দেবী স্বরসতী বার্জেভীব্র জিনিবতী ধিনামনিএজবতু .”
অথাৎ এই দেবী হল আমাদের পরম চেতনার দেবী। স্বেত রঙের দেবী সরস্বতী প্রাণিকূলে বিদ্যা ও বুদ্ধি যোগাবে তথা আমাদের মধ্যে আচার মেধা ও বৈভব জুগিয়ে আমাদের জীবকূলকে প্রকৃত শিখায় শিক্ষিত করে তুলবে, এই বলে মা দূর্গা শুন্যে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন।
প্রজাপতি ব্রহ্মার সৃষ্টির ত্রুটি দূরীকরণে মা সরস্বতীর এই আগমন তিথি ছিল মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমীর পূর্ণ্য দিন। তাই সেই রীতি নীতি মেনে হিন্দু ধর্মের মানুষেরা মাতা সরস্বতীকে বাগদেবী রূপে বসন্ত পঞ্চমীর দিন আরাধনা করে।
দেবী সরস্বতীর রং সাদা কেন- Saraswatir Rong Sada Keno
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার বিপরীত লিঙ্গ হল নারী শক্তির প্রতীক দেবী সরস্বতী। আদি শক্তির অঙ্গ বিশেষ হল দেবী সরস্বতী। দেবী সরস্বতী দেবী মহামায়ার দিব্য রূপের জৌতি থেকে শুভ্র রঙের দেবী সরস্বতীর আবির্ভাব হয়।

দেবী সরস্বতীর সাদা রং হল নিষ্কলুষতার প্রতীক। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর সাদা রং আমাদের শিক্ষা দেয়-দেবী সরস্বতীর ন্যায় আমাদের চরিত্র নিস্কলঙ্ক ও নির্মল হতে হবে। বিদ্যার দেবী সরস্বতী তার সর্বজ্ঞানে গুণান্বিত ও দোষহীন বলে দেবীর গায়ের রং শুভ্র অথাৎ সাদা হয়। দেবীর সাদা রং পবিত্রতার মূর্তি স্বরূপ।
সরস্বতীর হাতে বীণা থাকে কেন- Saraswatir Hate Bina Thake Keno
মা সরস্বতীর আর এক নাম হল বীণাপানি। দেবী সরস্বতীর হাতে বীণা থাকে বলে সরস্বতীকে বীণাপানি বলা হয়। এখানে ‘বীণা’ মানে বাদ্যযন্ত্র, আর ‘পাণি’ মানে হল হাত। দেবী সরস্বতী বিনার ঝংকারে ভেঁসে আসে নাদ।
শাস্ত্রমতে গুরুকুলে গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করার পর মা সরস্বতীর বীণার ধ্বনি শুনতে পেত। এমনিতেই বীণার সুর অত্যন্ত মধুর। মা সরস্বতীর হাতে বীণা থাকার অর্থ হল বিদ্যালাভের পর মা সরস্বতীর বীণার সুরের মত শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে নিঃসৃত বাক্য যেন ততটাই মধুর ও মনমুগ্ধকর হয়।
আমাদের হিন্দু সনাতন ধর্ম হল নাচ, গান, অঙ্কন, কারুকার্য শিল্পকর্মে পরিপূর্ন্য। যা সামাজিক ভাবে মানুষের চরিত্র গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। একজন বিদ্যার্থী যে শুধুমাত্র পুঁথি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পান্ডিত্য অর্জন করবে হিন্দু ধর্ম কিন্ত কোনোদিন এমন শিক্ষা দেয়না।
পুঁথিগত শিক্ষার বাইরে প্রতিটি মানুষের মধ্যে কোনো না কোনো ঈশ্বর প্রদত্ত গুন থাকে যেটা সম্পূর্ণ একটা অনবদ্য এবং অনন্য গুণ ! যেটা আর পাঁচটা মানুষের মধ্যে থাকেনা। তাই মানুষ তার চরিত্র গঠনে কর্ম মাধ্যম হিসাবে গান, বাজনা, অঙ্কন, অভিনয় ইত্যাদিকে তার পেশা হিসাবে বেছে নিতে পারে।
সরস্বতী পূজা pdf ডাউনলোড- Saraswati Puja pdf download
আমরা এখানে আপনাদের সুবিদার্থে সরস্বতী পূজা pdf ডাউনলোড করার লিংক দিয়ে দিলাম। আপনারা আমাদের লিংকের উপর ক্লিক করে সরস্বতী পূজা পদ্ধতি pdf ডাউনলোড করে নিতে পারেন। সরস্বতী পূজা পদ্ধতি pdf ডাউনলোড করার জন্যে নিচের লিংকের উপর ক্লিক করুন-
সরস্বতীর হাতে বই থাকে কেন- Saraswatir Hate Boi Thake Keno
দেবী সরস্বতী হল বিদ্যার দেবী, আর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য হল জ্ঞান অর্জন করা। মা সরস্বতীর হাতে রয়েছে “বেদ”. “বেদ” হল হিন্দু তথা বিশ্বের আদি গ্রন্থ। এখানে মা সরস্বতী বই হাতে নিয়ে আমাদের সমাজকে বৈদিক শিক্ষায় বিদ্যার আলোকে আলোকিত করে তোলার সন্দেশ বহন করছে।

মা সরস্বতীর বাহন হাঁস কেন- Maa Saraswatir Bahon Rajhans keno
স্বেতবর্ণের দেবী মা সরস্বতীর বাহন হল রাজহাঁস। সাদা রং হল শুভ্রতার প্রতীক। মা সরস্বতীর বাহন রাজহাঁসের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট গুন লক্ষ করা যায় যা কিন্তু আর সমস্ত প্রাণীর মধ্যে লক্ষ করা যায়না। রাজহাঁস পুকুরে ডুব দিয়ে পাঁকের মধ্যে থেকে
পাঁক আলাদা করে শুধু নিজের খাদ্যদ্রব্য টুকু খুঁজে নেয়। সেরকম একজন বিদ্যার্থীকে রাজহংসের ন্যায় জীব জগতের অসার/ভেজাল/অশুভ সবকিছু পরিত্যাগ করে জগৎ সংসার থেকে শুধুমাত্র স্বাত্বিক জিনিস গ্রহণ করে পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
পরিশিষ্ট
আমরা এতক্ষন বসন্ত পঞ্চমীতে সরস্বতী পূজা কেন করা হয় সেই বিষয়ে আলোচনা করলাম। তার পাশাপাশি মা সরস্বতীকে নিয়ে ছোট বড় প্রশ্ন যেমন- সরস্বতীর হাতে বীণা থাকে কেন, সরস্বতীর রং সাদা কেন, বসন্ত পঞ্চমী কি ? ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব আলোচনা স্বাপেক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
আশাকরি আপনাদের সরস্বতী পূজা কেন করা হয় আর্টিকেলটির মধ্যে দিয়ে আপনাদের মনে চলতে থাকা বিভিন্ন প্রশ্নের যথাচিত সমাধান আমরা করতে পেরেছি। তবুও আপনাদের মনে মা সরস্বতীকে নিয়ে কোনো ধরণের জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট করে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।
FAQ
প্রশ্ন- মা সরস্বতীর প্রণাম মন্ত্র কি ?
উঃ- “ওঁ মা সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললােচনে ।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমােহস্তুতে ।“
প্রশ্ন- মা সরস্বতীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র কি ?
উঃ- “ওঁ মা সরস্বত্যৈ নমাে নিত্যং ভদ্রকাল্যৈ নমাে নমঃ ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যাস্থানেভ্যঃ এব চ ।।
এষ সচন্দন-বিল্বপত্র-পুস্পাঞ্জলিঃ ওঁ শ্রীশ্রীসরস্বত্যৈ নমঃ “
প্রশ্ন- বসন্ত পঞ্চমীতে সরস্বতী পূজা করা হয় কেন ?
উঃ- হিন্দু শাস্ত্র মতে বসন্ত পঞ্চমীর দিন দেবী মহামায়ার অংশের জৌতি স্বরূপ মা সরস্বতীর আবির্ভাব হয়। সেই জন্যেই হিন্দু ধর্মালম্বীরা বসন্ত পঞ্চমীর দিন সরস্বতী পূজা করা হয়।
প্রশ্ন- সরস্বতী পূজা কবে ?
উঃ- ২০২৩ সালের ২৬ শে জানুয়ারী, বৃহঃস্পতি বার সরস্বতী পূজা।
প্রশ্ন- সরস্বতী পূজা কেন করা হয় ?
উঃ- মা সরস্বতী হল বিদ্যার দেবী। তাই মা সরস্বতীর আরাধনায় বসন্ত পঞ্চমীর দিন সরস্বতী পূজা করা হয়।