সনাতন হিন্দু ধর্মানুযায়ী শ্রী কৃষ্ণ হল ভগবান বিষ্ণুর অবতার। ভগবান বিষ্ণু কংসের অত্যাচার থেকে মথুরা বাসীকে রক্ষা করার জন্য দৈবকীর গর্ভে শ্রী কৃষ্ণ অবতারে জন্ম নেয়।
শ্রী কৃষ্ণের জন্মদিনকে হিন্দু ধর্মের মানুষেরা শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী হিসাবে পালন করে থাকে। আমরা এখন শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী কেন পালন করা হয় ?
শ্রী কৃষ্ণের জন্মদিনকে জন্মাষ্টমী কেন বলা হয় ? শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী কিভাবে পালন করা হয় ? শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলার একটি সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
Table of Contents
শ্রী কৃষ্ণের জন্মলীলা ও শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথি
ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জন্মলীলা ও শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথিতে ভগবান বিষ্ণুর,শ্রীকৃষ্ণ মানব অবতারে অবতারিত হলে ধ্বংস হয় কংস রাজা,রক্ষা পায় মথুরাবাসী।
মথুরার রাজা কংসের অত্যাচারে পুরো মথুরা রাজ্যবাসী শশব্যস্ত ছিল। কংসের বোন দৈবকীর বিবাহ মণ্ডপে, দৈবকী ও বাসুদেবের বিবাহের সময় আকাশ থেকে দৈব বাণী হয় যে,
দৈবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কংসকে বধ করে মথুরাবাসীকে কংসের হাত থেকে রক্ষা করবে। এই দৈব বাণী শোনার পর দুরাচারী রাজা কংস তার বোন দৈবকী ও বাসুদেবকে কারা গৃহে বন্দি করে দেয়।
এরপর দুরাচারী কংস রাজা কারাগারে মধ্যেই একে একে দৈবকীর গর্ভের ষষ্ঠ সন্তানকে (০৬ জন সন্তানকে) আছড়ে মেরে হত্যা করেন। পুত্র বিরহে দুঃখ বেদনায় কারাগারে দৈবকী ও বাসুদেবের দিন কাটতে থাকে।
কিছুদিন পর আবার দৈবকীর গর্ভে সপ্তম সন্তান আসে এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই গর্ভওবস্থাতেই দৈবকীর সপ্তম সন্তান মারা যায়।
কথিত আছে দৈবকীর গর্ভের সপ্তম সন্তান রোহানীর গর্ভে বলরাম রুপে জন্ম নেয়। এরপর ভাদ্র মাসে রোহিনী নক্ষত্রে কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে
ঝড় জলের রাত্রে ভগবান বিষ্ণু দৈবকীর গর্ভে অষ্টম সন্তান কৃষ্ণের মানবতার রুপে জন্ম নিলেন। কারাগারে স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু দৈবকী এবং বাসুদেবকে দর্শন দিয়ে,
তাদের পূর্ব জন্মের তপস্যার কথা মনে করালেন। তাদের তপস্যার পুন্য ফলেই ভগবান শ্রী বিষ্ণু দৈবকীর উদরে তিনবার জন্ম নেওয়ার প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন।
সেই প্রতিশ্রুতি রাখতেই তাই ভগবান বিষ্ণু দ্বাপর যুগে কংস নিধনের উদ্দেশ্যে তৃতীয় বার শ্রী কৃষ্ণ রুপে জন্ম দৈবকীর উদরে জন্মনিয়েছেন।
ভগবান এরপূর্বে তাদের কোলে প্রথম জন্মে বৃষ্ণীগর্ভ নামক পুত্র রুপে জন্ম নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার দৈবকী যখন দেবমাতা অদিতি ছিলেন তখন তিনি উপেন্দ্র নাম নিয়েতার উদরে জন্ম নিয়েছিলেন।
তিনিই আবার বামন অবতারে রাজা বলিকে উদ্ধার করেন। তৃতীয় বার দৈবকীর উদরে শ্রী কৃষ্ণের রূপ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে শ্রী বিষ্ণু তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখলেন।

এরপর ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় বন্দিগৃহের দরজা খুলে যায়। বসুদেব সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে কংসের হাত থেকে বালক কৃষ্ণকে রক্ষা করার জন্য বৃন্দাবনে তার বিশিষ্ট বন্ধু নন্দ ঘোষের ঘরে রেখে আসেন।
বসুদেব কৃষ্ণকে মাথায় নিয়ে যমুনা পেড়িয়ে যাওয়ার সময় শেষ নাগ ফণা উঁচিয়ে ছাতা ধরে যমুনার বুকে দুর্যোগের হাত থেকে ভগবান কৃষ্ণকে রক্ষা করে।
বৃন্দাবনে পৌঁছে বসুদেব কৃষ্ণকে বদলি করে নন্দ ঘোষের সদ্যজাত সন্তানকে নিয়ে এসে কারাগারে দৈবকীর হাতে তুলে দেয়।
কংস রাজা দৈবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর পেয়ে কারাগারে সদ্যজাতকে হত্যা করতে উদ্যত হলে সদ্যজাত কন্যা শিশুটি মা দুর্গার রূপে কংসকে দেখা দিয়ে
আকাশ থেকে দৈব বাণী করেন বলেন-‘তোমারে বধিবে যে,গোকুলে বাড়িছে সে।’আর তিনি হলেন মথুরা বাসীর পালনহার শ্রীকৃষ্ণ তিনিই কংসের হাত থেকে মথুরা বাসীকে উদ্ধার করবেন।
ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালন করা হয়। শ্রী কৃষ্ণের জন্মলীলা ও শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথির আনন্দে মেতে উঠে বিশ্বের সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বী মানুষেরা।
অবশ্যই পড়ুন : রামচন্দ্রের অকাল বোধন ও রামচন্দ্রের দূর্গা পূজার ইতিহাস।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনকে ‘জন্মাষ্টমী’ কেন বলা হয় (Sri Krishna Janmastomi)
ভগবান বিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণের অবতারে ধরা ধামে পাপ ও পাপীদের বিনাশ করার জন্ম নেয়। শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমীকে,জন্মাষ্টমী ছাড়াও
গোকুলাষ্টমী,শ্রীকৃষ্ণ জন্মজয়ন্তী,কৃষ্ণাষ্টমী,অষ্টমী রোহিণী ইত্যাদি নামে অনুকরণ করা হয়। হিন্দু পঞ্জিকা মতে সৌর ভাদ্র মাসে কৃষ্ণ পক্ষের রোহিনী নক্ষত্রে,
অষ্টমী তিথিতে দৈবকীর গর্ভে অষ্টম সন্তান রুপে মানবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়। ভগবান বিষ্ণু তার ‘অষ্টম’ অবতারে দৈবকীর গর্ভে ‘
অষ্টমী’ তিথিতে,’অষ্টম’ সন্তান হিসাবে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের রূপ নিয়ে,দৈবকীর গর্ভে জন্ম নেয়। তাই শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তিথিকে ‘জন্মাষ্টমী’ বলা হয়।
শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী কেন পালন করা হয়
হিন্দু পুরান অনুসারে আজ থেকে আনুমানিক প্রায় ০৫ হাজার বছর আগে,৩২২৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ১৯ জুলাই ভগবান বিষ্ণু অষ্টম অবতার স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ রুপে মানবতার নিয়ে ধরাধামে অবতীর্ণ হন।
সেই সময় মথুরার রাজা কংসের অত্যাচারে সমস্ত মথুরা নগরী ত্রাহিমাম রব তুলছিল। সেই সময় দুষ্টের দমনকারী ও শিষ্ঠের পালনহার
ভগবান শ্রী বিষ্ণু মানবতারে দৈবকীর গর্ভে অষ্টম সন্তান হিসাবে শ্রীকৃষ্ণ রূপে জন্ম নেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অমৃত প্রেমের বাণী ভগবদ গীতা গ্রন্থের মধ্যে শ্লোক হিসাবে বর্ণিত আছে।
শ্রীমৎ ভগবদ গীতায় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন ‘যখনই ধরাধাম মানবকুল পাপের ভারে ঝুকে যাবে,তখনই আমি অধর্মের পরাজয় এবং ধর্মকে রক্ষা করে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হব।’
হিন্দু ধর্মালম্বী মানুষদের কাছে শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী হল অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভ শক্তির জয়ের আনন্দ উৎসব। তাই সনাতন হিন্দু ধর্মের মানুষেরা
তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐক্যতান ধরে রাখার জন্য প্রতি বছর শ্রী কৃষ্ণের জন্ম তিথিকে শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী হিসাবে পালন করে থাকে।
শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী কিভাবে পালন করা হয়
বিশ্বের সনাতন হিন্দু ধর্মপ্রাণ মানুষ শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী সানন্দে পালন করে থাকে। তবে সনাতন ধর্মের শাক্য মত অপেক্ষা,
বৈষ্ণব মতাদর্শের লোকেদের কাছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা ও শ্রী কৃষ্ণের জন্মততিথির এক আলাদা গুরুত্ব আছে। শ্রীকৃষ্ণের জন্মজয়ন্তী উৎসব বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয়।
হিন্দু ধর্মের কিছু মানুষ ভগবৎ পুরানুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী তিথিতে মধ্যরাত্রে উপবাস ও ব্রত করে দহি হান্ডি উৎসব,রাধা কৃষ্ণের নৃত্যনাট্য পরিবেশন,
ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্যে দিয়ে রাধা কৃষ্ণের রাসলীলা রচনা করে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের ছোটবেলার বিভিন্ন ঘটনার পুনঃ নির্মাণ করে শ্রী কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করেন।
শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিতিথিতে জন্মাষ্টমী পালনের সময় দই হাঁড়ি ভাঙার একটি পুরোনো প্রথা আছে। দই হাঁড়ি উৎসবে অনেক উঁচুতে দই ও মাখনের হাঁড়ি বেঁধে,
শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের মাখনের হাঁড়ি ভাঙার ঘটনার পুনঃ নির্মাণ করা হয়। তারপর ছোট,ছোট ছেলেমেয়েরা একে অপরের কাঁধে চড়ে দলের সবথেকে ছোট বালকটির দ্বারা
উঁচুতে ঝোলানো দই মাখনের হাঁড়িটিকে ভাঙা হয়। জন্মাষ্টমীর দিনে অনেক পুরুষ ও মহিলা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উৎসর্গ করে ব্রত করে উপোস করেজন্মাষ্টমীর পুজো শেষ হলে প্রসাদ খেয়ে উপোস ভাঙে।
যে সমস্ত শ্রদ্ধালুর ঘরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাল্য মূর্তী আছে তারা ঠাকুর ঘরে আলপনা দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্ন আঁকে। শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যমূর্তি বাল গোপালকে মধ্যরাত্রে স্নান করানোর পর,
গা মুছিয়ে নতুন কাপড় পড়িয়ে,দোলনা চড়িয়ে দোলনা ঝোলানো হয়। এরপর গোপালের পূজা করে গোপালকে ভোগ দিয়ে ধর্মীয় গান গেয়ে নিজেদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করে উপবাস ভঙ্গ করা হয়।
অবশ্যই পড়ুন : রাখী বন্ধন উৎসব ও রাখী পূর্ণিমার ইতিহাস।
শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর পূজার উপকরণ ও জন্মাষ্টমীর পূজা পদ্ধতি
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যদিও মথুরাতে জন্মেছিলেন কিন্তু তার শৈশব কাটে নন্দ রাজার ঘরে বৃন্দাবনে। পুরো মথুরা ও বৃন্দাবন জুড়ে প্রায় ৪০০-র কাছাকাছি রাধা কৃষ্ণের মন্দির আছে।
ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে আমরা সাধারণত গাভী সহ বংশী বাদন রত অবস্থায় দেখতে পায়। শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রং কালো তাই শ্রী কৃষ্ণের ছবিতে কৃষ্ণের গায়ের রং নীলাভ বা কালো হয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বাল্যকালে নন্দ রাজার গরু চড়াতেন,তাই ভগবান কৃষ্ণের মধ্যে আমরা পশু প্রেম ভাব দেখতে পায়। এছাড়াও শ্রীকৃষ্ণের পড়নে হলুদ ধুতি এবং মাথায় ময়ূর পুচ্ছ সহ মুকুট থাকে।
আমাদের দেশে রাখী বন্ধন উৎসব পালনের ঠিক ০৭ দিন পরে অষ্টম দিনে শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালন করা হয়। জন্মাষ্টমীতে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের বাল্য রূপের পূজা করা হয়।
সাধারণত মাঝ রাত্রে অষ্টমী তিথিতে শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথি অনুযায়ী কৃষ্ণের বাল্য রূপকে স্নান করিয়ে,নতুন জামা কাপড় সহ দোলনায় ঝুলিয়ে উপবাস ও ব্রত রেখে শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী পালন করা হয়।
এছাড়াও জন্মাষ্টমীর দিন শ্রীকৃষ্ণকে সেবা দিয়ে পরিবারের মঙ্গল কামনায় অনেকে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তিথিতে শশা কেটে ভগবানকে উৎসর্গ করেন।
লোকমতে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে শ্রীকৃষ্ণকে শশা নিবেদন করলে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের আনুগত্য পাওয়া যায়। তাই অনেকে জন্মাষ্টমীর দিন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নাড়ি কাটার রূপক হিসাবে শশা কেটে থাকেন।
জন্মাষ্টমীর পূজার উপকরণ
এখানে আমরা ঘরোয়া ভাবে শ্রীকৃষ্ণের বাল গোপালের পূজা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। বাকি আপনি চাইলে পুরুত ঠাকুর দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে গোপালের পূজা করাতে পারেন।
যাদের ঘরে বাল গোপালের মূর্তি আছে তারা ঘরোয়া উপায়ে বাল গোপালকে পূজা দিয়ে সন্তস্ট করতে পারেন। ঘরোয়া উপায়ে খুব সামান্য আয়োজনে গোপালের পূজার আয়োজন করা যায়।
গোপালের জন্মাষ্টমী পূজার উপকরণ হিসাবে ফুল,বেল পাতা,তুলসী পাতা,মধু,ঘী,ধুপ,আতপ চাল,পঞ্চ প্রদীপ,আসন ও যথা সম্ভব ভোগের আয়োজন করে গোপালকে ভোগ নিবেদন করা যায়।
শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ব্রত পূজা করার নিয়ম
সবার প্রথমে বাল গোপালকে জন্মষ্টমীতে সেবা দেওয়ার জন্য শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর আগের দিন নিরামিষ খেয়ে নাপিত ডেকে হাত ও পায়ের আঙুলের নখ কেটে সংযম ব্রত পালন করতে হয়।
সংযম ব্রতর দিন রাত্রি বেলা ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২ টা বাজার আগেই রাতের ভোজন পর্ব সেরে নিতে হবে। এরপরের দিন অথাৎ শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর দিনসকাল থেকে মাঝ রাত্রি পর্যন্ত উপোসীদের উপোস থাকতে হয়।
আপনারা যেমন ঘরোয়া ভাবে একাদশীর ব্রত পালন করেন সেই নিয়মে ঐ দিন ভগবানের নাম কীর্ত্তন শ্রবণ এবং হরিনাম করতে হবে।

এরপর রাত্রি বেলা পঞ্জিকা মতে যথা সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অথাৎ গোপালের পূজা করতে হবে। পূজার আগে উপসীদের অবশ্যই স্নান করে নিতে হবে।
তারপর বাল গোপালকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন জামা কাপড় পড়িয়ে দোলনায় বসিয়ে গোপালের পূজা আরম্ভ করতে হবে।
পূজা আরম্ভ করার পূর্বে পূজার জোগাড় যেমন- প্রদীপ,ধুনো জ্বালিয়ে নিতে হবে। এরপর ঠাকুর ঘরের মেঝেয় আসন পেতে গোপালকে উৎসর্গ করার জন্য আতপ চালের নৈবদ্য সাজাতে হবে।
সঙ্গে গোপালের প্রিয় খাবার গুলি যেমন- তাল বড়া,তাল লুচি,মিছরি ও লাড্ডু দিয়ে ভোগ অর্পণ করতে হবে।এরপর চন্দন ঘষে গোপালের কপালে এবং নিজের কপালে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় তিলক আঁকতে হবে।
তারপর ওং বিষ্ণু,ওং বিষ্ণু,ওং বিষ্ণু তিনবার উচ্চারণ করে গঙ্গা জল ছিটিয়ে নিজেকে পবিত্র করে নিতে হবে।এরপর করজোড় করে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের প্রণাম মন্ত্র-
‘হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দিন বন্ধু জগৎ পথে গোপিসে গোপিকা কান্ত রাধা কান্ত নমস্তুতে’ তিন বার জপ করতে হবে।
শ্রী কৃষ্ণের প্রণাম হয়ে গেলে ঘন্টা বাজিয়ে ‘ওঁম ভগবতে বাসু দেবায় নমঃ’ মন্ত্র উচ্চারণ করে ফুল বেলপাতা আদি একে একে ভগবানের চরণে নিবেদন করুন।
এইভাবে পূজা সম্পন্ন হয়ে গেলে ভগবানের উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করতে হয়। কোনো কোনো ভক্ত তার শ্রাদ্ধ মত গোপালকে ৫৬ ভোগ নিবেদন করেন।
যাই হোক আপনি যে ভোগ নিয়ে গোপালের পূজা করছেন সেই ভোগই গোপালকে নিবেদন করুন। ভোগ নিবেদন হয়ে গেলে পঞ্চপ্রদীপে ঘী সলতে পাকিয়ে গোপালের আরতি করুন।
আরতি সম্পন্ন হয়ে গেলে সর্বশেষ শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়তে হবে,তার পরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর পূজা সম্পন্ন হবে।
শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী অথাৎ শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথিতে ছাপান্ন ভোগ নিবেদন করার মহত্ব
শ্রীকৃষ্ণের বাল্য লীলায় দেখতে পাওয়া যায় প্রতি বছর বৃন্দাবনবাসী বর্ষাকালে ব্রজপাতের হাত থেকে বৃন্দাবনকে রক্ষা করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের পূজা করত।
কিন্তু একবার বৃন্দাবনবাসী সময়মত দেবরাজ ইন্দ্রের পূজা না করায় দেবরাজ ইন্দ্র বৃন্দাবন বাসীর উপর রুষ্ঠ হয়ে একটানা ০৭ দিন বৃন্দাবনে ব্রজ বিদ্যুৎ সহ বর্ষণ করেন।
সেই সময় বাল গোপাল শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন বাসীকে ঝড় বৃষ্টি ও ব্রজ বিদ্যুতের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য গোবর্ধন পর্বতকে হাতে ধারণ করেছিলেন।
সেই যাত্রায় শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় সকল বৃন্দাবনবাসী গোবর্ধন পর্বতের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং দেবরাজ ইন্দ্রের ক্রোধ থেকে রক্ষা পায়।
শ্রীকৃষ্ণ হাতে গোবর্ধন পর্বতকে ধারণ করেছিলেন তাই কৃষ্ণের ১০৮ নামের মধ্যে এক নাম হল গিরিধারী। পুরানে কথিত আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দিনে ০৮ টি করে পদ দিয়ে আহার করতেন।
তিনি টানা ০৭ দিন অভুক্ত থেকে গোবর্ধন পর্বতকে ধরে রেখে বৃন্দাবনবাসীকে রক্ষা করেছিলেন তাই ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে কৃতজ্ঞতা জানার জন্য বৃন্দাবনবাসী
ভগবান শ্রী কৃষ্ণের প্রিয় পদগুলি ০৭ দিনের ০৮ প্রকারের পদ ০৭X ০৮=৫৬ রকমের পদ একসাথে নিবেদন করছিলেন। আর এই ৫৬ রকমের পদ পেয়ে বাল গোপাল খুব সন্তস্ট হয়েছিলেন।
তাই শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে সামর্থবান ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালনের সময় জন্মাষ্টমীর দিন ৫৬ প্রকারের ভোগ ভগবান শ্রী কৃষ্ণের নৈবেদ্যের থালায় অর্পণ করেন।
অবশ্যই পড়ুন : ০৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস কেন পালন করা হয়।
শ্রী কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম
শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে উপোসীরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর পূজা সেরে শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পাঠ করেন। শ্রী কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম হল কৃষ্ণর ১০৮ খানা আলাদা আলাদা নাম।
আপনাদের সুবিধার্থে শ্রী কৃষ্ণের ১০৮ খানা নাম তুলে ধরা হল আশাকরি কৃষ্ণ ভক্তদের উপকারে লাগবে। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম-
শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন।
যশোদা রাখিল নাম যাদু বাছাধন।
উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর গোপাল।
ব্রজবালক নাম রাখে ঠাকুর রাখাল।
সুবল রাখিল নাম ঠাকুর কানাই।
শ্রীদাম রাখিল নাম রাখাল রাজা ভাই।
ননীচোরা নাম রাখে যতেক গোপিনী।
কালসোনা নাম রাখে রাধা-বিনোদিনী।
কুজ্বা রাখিল নাম পতিত-পাবন হরি।
চন্দ্রাবলী নাম রাখে মোহন বংশীধারী।
অনন্ত রাখিল নাম অন্ত না পাইয়া।
কৃষ্ণ নাম রাখেন গর্গ ধ্যানেতে জানিয়া।
কন্বমুনি নাম রাখে দেব চক্রপাণী।
বনমালী নাম রাখে বনের হরিণী।
গজহস্তী নাম রাখে শ্রীমধুসূদন।
অজামিল নাম রাখে দেব নারায়ন।
পুরন্দর নাম রাখে দেব শ্রীগোবিন্দ।
দ্রৌপদী রাখিল নাম দেব দীনবন্ধু।
সুদাম রাখিল নাম দারিদ্র-ভঞ্জন।
ব্রজবাসী নাম রাখে ব্রজের জীবন।
দর্পহারী নাম রাখে অর্জ্জুন সুধীর।
পশুপতি নাম রাখে গরুড় মহাবীর।
যুধিষ্ঠির নাম রাখে দেব যদুবর।
বিদুর রাখিল নাম কাঙ্গাল ঈশ্বর।
বাসুকি রাখিল নাম দেব-সৃষ্টি স্থিতি।
ধ্রুবলোকে নাম রাখে ধ্রুবের সারথি।
নারদ রাখিল নাম ভক্ত প্রাণধন।
ভীষ্মদেব নাম রাখে লক্ষ্মী-নারায়ণ।
সত্যভামা নাম রাখে সত্যের সারথি।
জাম্বুবতী নাম রাখে দেব যোদ্ধাপতি।
বিশ্বামিত্র নাম রাখে সংসারের সার।
অহল্যা রাখিল নাম পাষাণ-উদ্ধার।
ভৃগুমুনি নাম রাখে জগতের হরি।
পঞ্চমুখে রাম নাম গান ত্রিপুরারি।
কুঞ্জকেশী নাম রাখে বলী সদাচারী।
প্রহ্লাদ রাখিল নাম নৃসিংহ-মুরারী।
বশিষ্ঠ রাখিল নাম মুনি-মনোহর।
বিশ্বাবসু নাম রাখে নব জলধর।
সম্বর্ত্তক নাম রাখে গোবর্দ্ধনধারী।
প্রাণপতি নাম রাখে যত ব্রজনারী।
অদিতি রাখিল নাম আরতি-সুদন।
গদাধর নাম রাখে যমল-অর্জুন।
মহাযোদ্ধা নাম রাখি ভীম মহাবল।
দয়ানিধি নাম রাখে দরিদ্র সকল।
বৃন্দাবন-চন্দ্র নাম রাখে বিন্দুদূতি।
বিরজা রাখিল নাম যমুনার পতি।
বাণী পতি নাম রাখে গুরু বৃহস্পতি।
লক্ষ্মীপতি নাম রাখে সুমন্ত্র সারথি।
সন্দীপনি নাম রাখে দেব অন্তর্যামী।
পরাশর নাম রাখে ত্রিলোকের স্বাম।
পদ্মযোনী নাম রাখে অনাদির আদি।
নট-নারায়ন নাম রাখিল সম্বাদি।
হরেকৃষ্ণ নাম রাখে প্রিয় বলরাম।
ললিতা রাখিল নাম বাদল-শ্যাম।
বিশাখা রাখিল নাম অনঙ্গমোহন।
সুচিত্রা রাখিল নাম শ্রীবংশীবদন।
আয়ন রাখিল নাম ক্রোধ-নিবারণ।
চন্ডকেশী নাম রাখে কৃতান্ত-শাসন।
জ্যোতিষ্ক রাখিল নাম নীলকান্তমণি।
গোপীকান্ত নাম রাখে সুদাম ঘরণী।
ভক্তগণ নাম রাখে দেব জগন্নাথ।
দুর্বাসা নাম রাখে অনাথের নাথ।
রাসেশ্বর নাম রাখে যতেক মালিনী।
সর্বযজ্ঞেশ্বর নাম রাখেন শিবানী।
উদ্ধব রাখিল নাম মিত্র-হিতকারী।
অক্রুর রাখিল নাম ভব-ভয়হারী।
গুঞ্জমালী নাম রাখে নীল-পীতবাস।
সর্ববেত্তা নাম রাখে দ্বৈপায়ণ ব্যাস।
অষ্টসখী নাম রাখে ব্রজের ঈশ্বর।
সুরলোকে নাম রাখে অখিলের সার।
বৃষভানু নাম রাখে পরম ঈশ্বর।
স্বর্গবাসী নাম রাখে সর্ব পরাৎপর।
পুলোমা রাখেন নাম অনাথের সখা।
রসসিন্ধু নাম রাখে সখী চিত্রলেখা।
চিত্ররথ নাম রাখে অরাতি দমন।
পুলস্ত্য রাখিল নাম নয়ন-রঞ্জন।
কশ্যপ রাখেন নাম রাস-রাসেশ্বর।
ভাণ্ডারীক নাম রাখে পূর্ণ শশধর।
সুমালী রাখিল নাম পুরুষ প্রধান।
পুরঞ্জন নাম রাখে ভক্তগণ প্রাণ।
রজকিনী নাম রাখে নন্দের দুলাল।
আহ্লাদিনী নাম রাখে ব্রজের গোপাল।
দেবকী রাখিল নাম নয়নের মণি।
জ্যোতির্ম্ময় নাম রাখে যাজ্ঞবল্ক্য মুনি।
অত্রিমুনি নাম রাখে কোটি চন্দ্রেশ্বর।
গৌতম রাখিল নাম দেব বিশ্বম্ভর।
মরীচি রাখিল নাম অচিন্ত্য-অচ্যুত।
জ্ঞানাতীত নাম রাখে শৌনকাদিসুখ।
রুদ্রগণ নাম রাখে দেব মহাকাল।
সুরগণ নাম রাখে ঠাকুর দয়াল।
সিদ্ধগণ নাম রাখে পুতনা-নাশন।
সিদ্ধার্থ রাখিল নাম কপিল তপোধন।
ভাদুরি রাখিল নাম অগতির গতি।
মৎস্যগন্ধা নাম রাখে ত্রিলোকের পতি।
শুক্রাচার্য্য নাম রাখে অখিল বান্ধব।
বিষ্ণুলোকে নাম রাখে দেব শ্রীমাধব।
যদুগণ নাম রাখে যদুকুলপতি।
অশ্বিনীকুমার নাম রাখে সৃষ্টি-স্থিতি।
অর্য্যমা রাখিল নাম কাল-নিবারণ।
সত্যবতী নাম রাখে অজ্ঞান-নাশন।
পদ্মাক্ষ রাখিল নাম ভ্রমরী-ভ্রমর।
ত্রিভঙ্গ রাখিল নাম যত সহচর।
বংকচন্দ্র নাম রাখে শ্রীরূপমঞ্জরী।
মাধুরা রাখিল নাম গোপী-মনোহারী।
মঞ্জুমালী নাম রাখে অভীষ্টপুরণ।
কুটিলা রাখিল নাম মদনমোহন।
মঞ্জরী রাখিল নাম কর্ম্মব্রহ্ম-নাশ।
ব্রজব নাম রাখে পূর্ণ অভিলাস।
শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর গান
শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর গান আপনাদের জন্য শেয়ার করা হল,আসা করি আপনারা সকলে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর গান গুলি উপভোগ করবেন।
FAQ
প্রশ্ন- শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তারিখ কত ?
উঃ- শ্রী কৃষ্ণ আজ থেকে আনুমানিক প্রায় ০৫ হাজার বছর আগে ৩২২৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ১৯ জুলাই জন্ম নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
প্রশ্ন- শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীর নাম কি ?
উঃ- শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীর নাম হল রুক্মণী দেবী।
প্রশ্ন- শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ২০২৩ বাংলা কত তারিখ ?
উঃ- শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ২০২৩ সালে ভাদ্র মাসের ১৯ তারিখ বুধবার সন্ধ্যা ০৭ টা ৫৭ মিনিট থেকে শুরু করে ২০ তারিখ বৃহস্পতি বার ভোর ০২ টা ৩৯ মিনিট পর্যন্ত।
প্রশ্ন- শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ২০২৩ সালের ইংরেজি কত তারিখ ?
উঃ- শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ইংরেজী ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর বুধবার।
প্রশ্ন- শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের বাণী কোন গ্রন্থে লেখা আছে ?
উঃ- শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের বাণী শ্রীমৎ ভগবদ গীতায় লেখা আছে।
প্রশ্ন- শ্রীকৃষ্ণের বাহন কি ?
উঃ- শ্রীকৃষ্ণের বাহন হল গাভী।
পরিশিষ্ট
প্রিয় পাঠক এতক্ষন আপনাদের সম্মুখে শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী কেন পালন করা হয় ? শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর পূজা পদ্ধতি,শ্রী কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম/ শ্রী কৃষ্ণের ১০৮ টা নাম
এবং শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর ব্রত কিভাবে করতে হয় হয় যথা সম্ভব সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। আসা করি আপনারা হিন্দু ধর্মে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর তাৎপর্য টুকু বোঝাতে পেরেছি।
এছাড়া শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী নিয়ে আপনাদের কোনো জিজ্ঞাসা থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট করে জানাবেন। ধন্যবাদ।
এই আর্টিকেল গুলোও পড়ে দেখুন-
- ভারতের নতুন শিক্ষা নীতি।
- জগন্নাথ মন্দিরের রহস্য ও জগন্নাথ মন্দিরের ইতিহাস।
- মহাত্মা গান্ধী মৃত্যু রহস্য।