আমরা শনি মহারাজকে গ্রহরাজ শনিদেব বলে সম্বোধন করে থাকি। শনিদেবের পূজার সাথে শনির পাঁচালী,শনিদেবের ব্রতকথা আদি পাঠ করা হয়।
শনিদেবের পূজা মূলত শনির সাড়েসাতি দোষ কাটানোর জন্যে করা হয়। তবে শনিদেবের ভক্তরা শনিবার উপবাস ব্রত রেখে শনিদেবের পূজা করেন।
সমগ্র হিন্দুদের কাছে শনি মানেই বক্রদৃষ্টির দেবতা, তাই যে জাতকের উপর শনিদেবের বক্রদৃষ্টি পড়ে তার অমঙ্গল হওয়া নিশ্চিত। একবার শনিদেব হনুমানের উপর শনি সাড়েসাতি দোষ নিয়ে শীরে চড়াও হয়।
হনুমান তখন গ্রহরাজ শনিদেবের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে নিজের শীরের উপর প্রচন্ড বড় একটা পাথর রেখে দেয়। এদিকে পাথরের ভারে শনিদেবের প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হলে
শনিদেব তখন হনুমানজির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, সেই যাত্রায় হনুমানজী শনিদেবকে ছেড়ে দেন। শনিদেব তখন হনুমানজীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন যে জনেরা হনুমানজীর পূজা করবে,
শনিদেবের বক্রদৃষ্টির প্রকোপ সেই জাতকের উপর পড়বেনা। তাই শনিদেবের পূজা করার সাথে সাথে হনুমান চালিশা পাঠ করলে হনুমানজীর সাথে সাথে শনিদেব সন্তস্ট হয়।
আমরা আমাদের আর্টিকেলে শনিদেবের পাঁচালী, শনিদেবের বীজ মন্ত্র তুলে ধরব আপনারা এখান থেকে শনির পাঁচালী পাঠ করে শনিদেবের পূজা করতে পারেন।
Table of Contents
শনিদেবের বীজ মন্ত্র (Shoni Deber Beej Mantra)
বৈদিক গ্রন্থ অনুযায়ী বলা হয় শনিদেবের বীজ মন্ত্র উচ্চারণ করে শনিদেবকে জাগ্রত করতে হয়। শনিদেবের বীজ মন্ত্র হল –
ওঁ প্রাং প্রীং প্রৌং শনৈশ্চরায় নমঃ

শনির পাঁচালী (Shoni Deber Pujar Panchali)
আপনারা যারা শনিদেবের পূজা করেন তারা জানেন শনি পূজার সময় শনি প্রণাম মন্ত্র জপ করে শনি পাঁচালী, শনি চালিশা পাঠের সাথে শনিদেবের ১০৮ নাম জপ করা হল শনি পূজার অঙ্গ বিশেষ।
আমরা এখানে এখন শনির পাঁচালী আপনাদের জন্যে শেয়ার করে দিলাম, আপনারা এখান থেকে শনির পাঁচালী পাঠ করতে পারেন। শ্রী শ্রী শনিদেবের পাঁচালী-
শ্রীহরি নামেতে এক ছিল যে ব্রাহ্মণ
নিত্য ভিক্ষা করি উদর পুরণ।।
দিবা রাত্র কৃষ্ণনাম জপে অকপটে।
অন্তরে সদাই সুখী অন্ন নাহি পেটে৷৷
হেনকালে তার এক পুত্র জনমিল।
পূত্র মুখ দেখি দ্বিজ বিবাদে ভাসিল।।
ভিক্ষা করি দ্বিজসেবা পুত্র রক্ষা করে।
সুমঙ্গল বলি নাম রাখিল পুত্রেরে।।
অত্যন্ত মেধাবী পুত্র সবে গুণ গায়।
অল্পদিন মধ্যে শিশু শিখে সমুদয়।।
শাস্ত্র আলােচনা করি শাস্ত্রজ্ঞ হইল।
পণ্ডিত বলিয়া তারে সকলে জানিল।।
মনে মনে সুনঙ্গল হরিকে ডাকিল।
গৃহ ছাড়ি নানা তীর্থে ঘুরিতে লাগিল।।
আচম্বিতে এক স্থানে করিল শ্রবণ।
পিতা-মাতা পরলােকে করেছে গমন।
শুনি তাহা গয়াধামে করিয়া গমন।
বিষ্ণুপাদ-পদ্মে শিশু করিল অর্পণকালবশে
ঘটে যাহা কে করে খণ্ডন।
শনির দৃষ্টিতে পড়ে দ্বিজের নন্দন।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে দ্বিজ যায় বহুদুরে।
শেষে উপস্থিত হয় বিদর্ভ নগরে।
রাজার সভায় দ্বিজ উপস্থিত হৈল ব্রাহ্মণ
দেখিয়া রাজা অভ্যর্থনা লৈ৷
রাজার নিকটে দ্বিজ দেয় পরিচয়।
সুমঙ্গল নাম মের ওহে মহাশয়।৷
অতি দুঃখী হই আমি নাহি পিতা-মাতা।
নানা দেশ ভ্রমি আমি থাকি যথা তথা।
শ্রীবৎস রাজন বলে, চিন্তা দুর কর।
আমার আশ্রয়ে থাকি মােরে কৃপা কর।
শাস্ত্রজ্ পণ্ডিত তুমি বুঝি অনুমানে।
শাস্ত্রপাঠে তুষ্ট কর সভাসদগাণে।
দুই পুত্র আছে মাের শুন হৈব্রাহ্মণ।
পড়াইব তব কাছে করিয়াছি মন।।
রাজার বাক্যেতে দ্বিজসম্ভুট হইল।
রাজার আশ্রয়ে বাস করিতে লাগিল।।
দুই রাজপুত্রে দ্বিজ অতি যত্ন করে।
নিত্যই পড়ায় দ্বিজ রাজার কুমারে।।
এইরূপে কিছুদিন বিশ্বত হইল।
পড়ুয়া বেশেতে শনি উপস্থিত হইল।
শনিরে জিজ্ঞাসে দ্বিজ, শুন বাছাধন।
কিবা হেতু হেথা তব হয় আগমন।।
শনি বলে, এন শাস্ত্র অধ্যয়ন তরে।
দ্বিজ বলে, যত করি পড়াব তােমারে।
অল্পদিন মধ্যে শনি সুপণ্ডিত হৈল।
সুমঙ্গল পরিচয় জানিতে চাহিল।।
শনি বলে, পরিচয় কিবা দিব আর।
শনৈশ্চর নাম মাের সূর্যের কুমার।।
সুমঙ্গল বলে যদি দেখা দিলে মােরে।
কিসে দুঃখ দূরে যাবে বল হে আমারে।।
আমার উপরে আছে তােমার কটাক্ষ।
কিসে যাবে বল প্রভু হইয়া স্বপক্ষ৷শনি বলে,
ভােগকাল ছয়মাস আছে।
দশদণ্ড মধ্যে যাবে না আসিবে কাছে।।
সপ্তম দিবসে গিয়া ভগীরথী তীরে।
একান্ত মনেতে দ্বিজ ভজ মুরারীরে।।
এত বলি শনিদেব অন্তর্ধান হৈল।
সুমঙ্গল আর তার দেখা না পাইল।
শনি আজ্ঞামত দ্বিজ গিয়া গঙ্গাতীরে।
নারায়ণে ভজে দ্বিজ একান্ত অন্তরে।।
দশদণ্ড পূর্ণ হৈল মনেতে বিচারি।
উঠি দাঁড়াইল দ্বিজ বলিয়া শ্রীহরি।
কিন্তু দশদণ্ড পূর্ণ না হয় তখন
তার পূর্বে চলে আসে আপন ভবন।।
তাহা দেখি শনিদেব কৃপিত হইল।
দুই রাজপুত্রে শনি হরণ করিল।
পুনঃ মায়া বলে দুই শিশু মুণ্ড গড়ি।
দ্বিজের নিকটে শনি যান তাড়াতাড়ি।।
হেথা দ্বিজ চক্ষু বুজি শ্রীহরিরে স্মরে।
মুণ্ড দুটি ফেলে তার উরুর উপরে।
হেথা নিদ্রা যােগে রাজা দুঃস্বপ্ন দেখিল।
পাত্রমিত্র। গঙ্গাতীরে গেল।
দেখিয়া দ্বিজের কোলে পুত্র মুণ্ডদ্বয়।
হাহাকার করি রাজা ধুলায় লুটায়।
রাজাদেশে দূতগণ বাঁধে ব্ৰণেরে।
শৃঙ্খলে বন্ধন করি রাখে কারাগারে।।
কারাগারে বসি দ্বিজ কাদিতে লাগিল।
বিপদহস্তা মধুসুদনে স্মরিতে লাগিল।
অতঃপর ঘটে এক বিচিত্র ঘটন।
দশদণ্ড বেলা পূর্ণ হইল যখন।
শােকেতে কাতর রাজা ছিলেন যেখানে।
হেনকালে দুই পুত্র আসিল সেখানে।।
রাজা বালে, কোথা ছিলে হৃদয়ের ধন।
শয্যা পরে ছিনু পিতা করিয়া শয়ন।
পুত্রদের বাক্যে রাজা আশ্চর্য হইল।
আদ্য অন্ত কিছু তার বুঝিতে নারিল।।
ব্রাহ্মণের কথা এবে পড়ে গেল মনে।
না বুঝিয়া কত কষ্ট দিনু সে ব্রাহ্মণে৷৷
রাজাদেশে দূত গিয়া আনিল বিপ্রেরে।
জীর্ণ শীর্ণ কলেবর কাদেন কাতরে।।
বিনয় বচনে রাজা করে তার স্তুতি।
সব অপরাধ ক্ষমা কর মহামতি।
কৃপা করি কর মাের সন্দহ ভঞ্জন।
তব ক্রোড়ে কার মুণ্ড করেছি দর্শন।।
দ্বিজ বলে, মহারাজ কিছুই না জানি।
শনি কোপে কষ্ট পাই এইমাত্র মানি।
রাজা বলে, যদি পাই শনি-দরশন।
সােড়শােপচারে তার করিব পূজন।।
নৃপবাক্য শুনি দ্বিজ করিল গমন।
শনির নিকটে সব করে নিবেন।
শুনিয়া সকল কথা শনিদেব এল।
শনিদেবে দেখি রাজা প্রণাম করিল।
রাজা বলে যদি প্রভু এলে কৃপা করে।
পূজার বিধান তবে বল প্রভু মােরে।
শনি বলে, পূজাবিধি শুনহে রাজন।
যেরূপে করিবে মাের পূজা আয়ােজন।
শুদ্ধভাবে শুদ্ধমনে আমার বারেতে।
করিবে আমার পূজা একান্ত মনেতে।
নীলবস্ত্র কৃষ্ণতিল আর তৈল দিবে।
মাষকলাই আর মােষ সংগ্রহ করিবে।
কৃষ্ণবর্ণ ঘট এক করিয়া স্থাপন।
পঞ্চজাতি ফল-ফুলে করিবে অর্চন।।
এই মাের পূজাবিধি কহিলাম সার।
ভক্তিই প্রধান জেনাে কি কহিব আর।।
পূজা-শেষে ভক্তিভরে করিবে প্রণাম।
নবগ্রহ স্তোত্র পাঠে লইবেক নাম।
আমার প্রসাদ খাবে করিয়া যতন।
সর্বপাপ দূরে যাবে আমার বচন।
অভক্তি করিয়া যেবা প্রসাদ খাইবে।
অল্পদিনে শমনের ভবনে সে যাবে।
আমার পূজায় যেবা করে অনাদর।
চিরকাল দুঃখ পেয়ে হইবে কাতর।
এত বলি শনিদেব হন অদর্শন।
ভক্তিভরে করে রাজা শনির পূজন।
প্রতি শনিবারে পূজা করে নৃপবর।
বিপ্রগণে দান দিয়া তুষিল বিস্তর।।
নৃপ-পাশে সুমঙ্গল বিদায় লইয়া।
শনিদেবে পূজা করে গঙ্গাতীরে গিয়া।।
এইরূপে পূজা প্রচারিল শনিদেবে।
যাহার যেমন সাধ্য সে ভাবে পূজিবে।।
শনির মাহাত্ম্য যত কে বর্ণিতে পারে।
কিঞ্চিৎ রচিত হৈল শনিদেবের বরে।।
সর্বদা শনির পদ থাকে যার মনে।
উদ্ধারে বিপদ হতে পড়িলে শমনে।
শনির পাঁচালী যেবা রাখিবে ভবনে।
কখনও না পড়ে সে বিপদ বন্ধনে।।
শনি প্রণমিয়া যেবা নিজ কার্য্যে যায়।
সমাদর করে তারে রাজার সভায়।
স্কন্দ পুরাণের কথা অন্যথা না হয়।
যথাবিধি ব্যাসবাক্য কভু মিথ্যা নয়।।
শুদ্ধাশুদ্ধ জ্ঞানহীন বলে নিবারণ।
ভূমিতে লুটিয়া বন্দি শনির চরণ।।
এতদূরে এই গ্রন্থ সমাপন করি।
শনৈশ্চর প্রীতে সবে বল হরি হরি।।
পরিশিষ্ট
নিত্যদিন শনিপূজার সাথে সাথে শনির পাঁচালী পাঠ করলে সেই ভক্তের গ্রহ দোষ কেটে যায়। পরিবারে সুখ শান্তি ফিরে আসে,জীবনের সমস্ত দুর্বিধা দূর হয়ে যায়।
শনিদেব সেই জাতকের উপর বক্রদৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কৃপাদৃষ্টি বর্ষণ করেন। জাতকের মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় জীবনে শুভ কাজে কোনো বাধা বিপত্তি আসেনা। বল বল গ্রহরাজ শনিদেব কি জয়।
খুবই উপকৃত হলাম, ধন্যবাদ আপনাদের ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ, অনেক সুন্দর হয়েছে।