লিওনার্দো ভিঞ্চির অনবদ্য শিল্পকর্ম হল মোনালিসা চিত্রকর্ম। ভিঞ্চির মোনালিসা ছবির অজানা রহস্য এবং মোনালিসা ছবির ইতিহাস কার না জানতে ইচ্ছে করে !
মোনালিসা ছবির অজানা রহস্য জানতে মানুষ এতো বেশি উৎসুক যে- আবার অনেকে মোনালিসা ছবির দাম কত,মোনালিসা ছবিটি আঁকতে কত সময় লেগেছিল,
মোনালিসা ছবি কেন বিখ্যাত,মোনালিসা ছবি কার আঁকা,মোনালিসা ছবি কোন মিউজিয়ামে আছে,মোনালিসা চিত্রকর্ম রহস্যময় কেন,মোনালিসা হাঁসির রহস্য কি ?
এরকম নানান ধরণের কৌতূহল মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। তাই আজকে আমরা মোনালিসা ছবির অজানা রহস্যের পিছনের পর্দা সরানোর চেষ্টা করব।
Table of Contents
মোনালিসা কে (Who is Monalisa)
মোনালিসা কে ছিল ? মোনালিসার পরিচয় সনাক্তকরন করা হল মোনালিসা ছবির অজানা রহস্যের মধ্যে একটি অন্যতম রহস্য। মোনালিসা কে ?
তার সঠিক কোনো তথ্য প্রমান আজ পর্যন্ত কেউ সঠিকভাবে দিয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষজ্ঞ দল অনেক অধ্যয়নের পরে মোনালিসাকে নিয়ে বেশ কিছু তথ্য সামনে নিয়ে এসেছে,
যা থেকে মোনালিসার পরিচয় সম্পর্কে মোটামোটি একটি ধারণা পাওয়া গেছে। লিওর্নাদো ভিঞ্চির এজজন শিষ্য সলাই কো,তার ডাইরিতে লিখেছেন ১৫২৪ সালে লিওর্নাদো ভিঞ্চির মৃত্যু আসন্ন হলে
সলাই কো,কে একটি পেন্টিং দিয়ে যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে পেন্টিংটির নির্দিষ্ট করে কোনো নামের উল্লেখ সলাই কো এর ডাইরিতে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এখন সবথেকে বড় প্রশ্ন হল সলাই কো,যে ছবিটিটির কথা তার ডাইরিতে উল্লেখ করেছেন সেই ছবিটিই কি মোনালিসার ছবি ?
১৫৫০ সালে লিওনার্দো ভিঞ্চির প্রথম জীবনী লেখক ইতালির বিখ্যাত কলা ঐতিহাসিক গিওর্গিও ভাসারি প্রথম লিওনার্দো ভিঞ্চির জীবনীতে মোনালিসা (Monalisa) নামটির উল্লেখ করেন।
গিওর্গিও ভাসারি লিখেছেন লিওনার্দো ভিঞ্চি ফ্লোরেন্সের একজন ব্যাক্তি ফ্রান্সিস দেল গিওকোন্দোর স্ত্রীর মোনালিসার ছবি এঁকেছিলেন।
ইতালীয় ভাষায় মোনালিসা (Monalisa) নামের অর্থ হল- Mona মানে Madam অথবা My Lady,তাই অনেকের মতে লিওনার্দো ভিঞ্চি ফ্রান্সিস দেল গিওকোন্দোর স্ত্রী Madam লিসার ছবি এঁকেছিলেন।
অনেকে আবার ঐতিহাসিক গিওর্গিও ভাসারির এই তথ্যকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না,কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে ঐতিহাসিক গিওর্গিও ভাসারি লিওনার্দো ভিঞ্চি মারা যাওয়ার
৩১ বছর পরে লিওনার্দো ভিঞ্চির জীবনী লেখা শুরু করেন। তাই লিওনার্দো ভিঞ্চিকে নিয়ে লেখা ঐতিহাসিক গিওর্গিও ভাসারির সব তথ্য নির্ভুল না হতেও পারে।
২০০৫ সালে জার্মানির হাইদ্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক ৫০০ বছরের পুরোনো একটি বইয়ের পাতার মধ্যে একটি হাতের লেখা নোট পায়।
অধ্যাপক দাবি করেন এই নোটটি ১৫০৩ সালের ভিঞ্চির সময়ের হাতে লেখা নোট। নোটটি লেখা হয়েছিল Agestion Vespuchi নামের একজন বিদ্যান পন্ডিত দ্বারা।
নোটটির মধ্যে প্রাচীন গ্রীক চিত্রকর Applas এর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সময় লিওনার্দো ভিঞ্চিকে Applas বলে সমন্ধিত করা হত।

যিনি ১৫০৩ সালে লিজা গিওকোন্দো নামে একজন মহিলার ছবি আঁকছিলেন। এই থেকে প্রমান হয়ে যায় যে লিওনার্দো ভিঞ্চি যে ছবিটি আঁকছিলেন সেই ছবিটা ছিল লিজা গিওকোন্দোর।
আবার অনেকের মতে লিওনার্দো ভিঞ্চি মোনালিসা (Monalisa) ছবিটির মধ্যে তার নিজের ছবি এঁকেছিলেন। মোনালিসা ছবিটাকে ভালো ভাবে দেখলে দেখতে পাওয়া যায়,
মোনালিসা ছবিটির মধ্যে বিনা দাড়ি গোফে ভিঞ্চি তার নিজের ছবিকে পরিস্ফুটিত করে একজন মহিলার রূপ দিয়েছেন। মোনালিসার ছবিটিতে দাড়ি গোফ জুড়ে দিলে
ছবিটিতে হুবহু লিওনার্দো ভিঞ্চির ছবি ফুটে ওঠে। আবার অনেকের মতে লিওনার্দো ভিঞ্চি মোনালিসা ছবিটির মধ্যে তার নিজের প্রেমিকার ছবি এঁকেছিলেন।
কেউ কেউ আবার মনে করেন লিওনার্দো ভিঞ্চির মা একজন পতিতা ছিলেন,ভিঞ্চি তার মাকে কোনোদিন স্ব-চক্ষে দেখার সুযোগ পায়নি।
তাই তিনি কল্পনার নিরিখে তার রং তুলি দিয়ে মোনালিসা (Monalisa) ছবিটির মধ্যে লিওনার্দো ভিঞ্চি তার মায়ের ছবি এঁকেছিলেন।
আরো পড়ুন : অভিশপ্ত কোহিনুর হীরার ইতিহাস।
মোনালিসা ছবি কেন বিখ্যাত (Why is Monalisa Painting Famous)
মোনালিসা ছবিটি ৫০০ বছরেরও বেশি পুরোনো একটা চিত্রকর্ম। সমগ্র বিশ্বের দরবারে মোনালিসা ছবির ইতিহাসের একটি আলাদা ঐতিহাসিক মূল্য আছে।
তবে মোনালিসা চিত্রকর্ম বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার অন্যতম কারণ হল ঊনিবিংশ শতাব্দীর অন্যতম চিত্রকর লিওনার্দো ভিঞ্চির নিজের হাতে আঁকা পেন্টিংয়ের জন্য,
মোনালিসা ছবির ইতিহাস বিশ্বের দরবারে এক আলাদা ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়েছে। সমগ্র বিশ্বে মোনালিসার (Monalisa) প্রেমিক মানুষ নেই এমন মানুষ মেলা ভার।
আপনারা জেনে হয়ত অবাক হবেন বিশ্বে এমন সব মানুষ আছেন যারা মোনালিসার প্রেমে নিজের জীবন পর্যন্ত শেষ করে দিয়েছেন।
১৮৫২ সালের ২৩ শে জুন,লুস মাসপেরো নামের একজন ফ্রান্সের শিল্পী মোনালিসার হাঁসির সৌন্দর্যে উন্মাদ হয়ে প্যারিসের একটি ০৪ তলা হোটেল থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
পুলিশ তল্লাশি করে তার সুইসাইড নোট উদ্ধার করেন। সেই সুইসাইট নোটের মধ্যে মোনালিসার প্রতি তার অকৃতিম ভালোবাসার উল্লেখ পাওয়া যায়।
মোনালিসা হাঁসির রহস্য
মোনালিসা চিত্রকর্মের রহস্যের মধ্যে অন্যতম হল মোনালিসার হাঁসির রহস্য। মোনালিসা চিত্রকর্মে মোনালিসার হাঁসির প্রেমে মজেননি এরকম মানুষ অনেক কম আছেন।
মোনালিসা চিত্রকর্মটিকে আলাদা,আলাদা কোন থেকে দেখলে দেখতে পাওয়া যায়,মানুষের দৃষ্টি ও কোনের আঙ্গিক ব্যবধানে মোনালিসার হাঁসি সময় বিশেষে বদল হতে থাকে।
প্রথমে মোনালিসাকে হাঁসতে দেখা যায়,পরে ধীরে,ধীরে এই হাঁসি ম্লান হয়ে যায়। মোনালিসা হাঁসির রহস্য গবেষণা করে দেখা গেছে মোনালিসার হাঁসির মধ্যে রহস্য লুকিয়ে আছে।
যার জন্য মোনালিসার হাঁসির মধ্যে সময় বিশেষে হাঁসির রদবদল হতে দেখা যায়। বেশ কয়েক বছর আগে একজন দন্ত রোগ বিশেষজ্ঞ মোনালিসার হাঁসির রহস্যের
কিনারা করে বলেন মোনালিসার উপরের পাটির ০২ টি দাঁত ভাঙা হওয়ার কারণে,মোনালিসার উপরের ঠোঁট কিছুটা দাবানো তাই মোনালিসাকে এক দৃষ্টিতে দেখলে হাঁসছে বলে মনে হয়।
২০০০ সালে নিউরো বিজ্ঞানী ডঃ মর্গেটর তার তথ্যে বলেন মোনালিসার ছবির মধ্যে আলাদা করে কোনো মোনালিসার হাঁসির রহস্য নেই।
মোনালিসার হাঁসির মধ্যে কোনো রকম পরিবর্তন হয়না। আসলে পরিবতর্ন হয় মানুষের মস্তিষ্কে চলা মোনালিসাকে নিয়ে অহেতুক চিন্তা ধারার।
তাই কোনো ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত চিন্তা ধারা দিয়ে মোনালিসাকে যে ভাবে দেখতে চায়,সেই ব্যক্তি মোনালিসাকে ঠিক সেরকম ভাবে দেখে।
আরো পড়ুন : মিশরের পিরামিডের রহস্য।
মোনালিসা ছবির অজানা রহস্য (What is the story behind Monalisa)
অনেকে প্রশ্ন করেন মোনালিসা ছবিটি আঁকতে কত দিন সময় লেগেছিল ? তাহলে জেনে রাখুন ঊনিবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত চিত্রকর লিওনার্দো ভিঞ্চি
১৫০৩ সালে মোনালিসা ছবিটি আঁকতে শুরু করেন এবং ১৫১৭ সাল পর্যন্ত মোনালিসা ছবিটির উপর শিল্পকর্ম চালিয়ে যান। মোনালিসা ছবিটিতে লিওনার্দো ভিঞ্চি সবথেকে বেশি সময় দেন
মোনালিসার ঠোঁট পেন্টিং করার জন্য। সবমিলিয়ে মোনালিসার শুধু ঠোঁট আঁকার জন্য ভিঞ্চি ১২ বছর সময় লাগিয়ে দেন।
মোনালিসা ছবির অজানা রহস্য ও মোনালিসা চিত্রকর্ম তৎকালীন তথা আধুনিক বিশ্বের কলাপ্রেমী মানুষদের কাছে এক অনবদ্য শিল্পকর্ম।
তবে মোনালিসা (Monalisa) ছবিটি আধুনিক বিশ্বে জনপ্রিয়তার নিরিখে যতটা আজকের দিনে চর্চিত হয়ে আসছে ঊনিবিংশ শতাব্দীতে কিন্তু ততটা জনপ্রিয় ছিলনা।
মোনালিসা চিত্রকর্মের রহস্য বলতে আলাদা করে কিছু ছিলনা। আর পাঁচটা ছবির মত মোনালিসা ছবিটি ফ্রান্সের লুবর মিউজিয়ামে শোভা বাড়াতো এই মাত্র।
১৯১১ সালে ২১ শে আগস্ট ফ্রান্সের লুবর মিউজিয়াম থেকে মোনালিসা ছবিটি চুরি হয়ে যাওয়ার পর থেকে মানুষ মোনালিসা ছবির ইতিহাস ও ঐতিহাসিক মূল্যের প্রতি নূতন করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
আপনারা জানলে হয়ত অবাক হবেন মোনালিসা ছবিটি চুরি হয়ে যাওয়ার পর বেশকিছুদিন লুবর মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষ মোনালিসা ছবিটি চুরি হয়ে গেছে তারা বুঝে উঠতে পারেননি।
মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষের মনে হয়েছিল আর পাঁচটা ছবির মত মোনালিসা ছবিটিকে মিউজিয়ামের কোনো কর্মচারী সাফ সাফায়ের জন্য অনত্র কোথাও সরিয়ে রেখেছে হয়ত।
পরে যখন লুবর মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানতে পারে যে মোনালিসা ছবিটি মিউজিয়াম থেকে চুরি হয়ে গেছে তখন মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ মেন্টেনেন্সের অজুহাতে বেশ কয়েকদিন লুবর মিউজিয়ম বন্ধ রাখেন।
মোনালিসা চিত্রকর্মটি চুরি হয়ে যাওয়ায় পিছনে বিংশ শতাব্দীর এক বিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোর নাম জড়িয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে
মোনালিসা (Monalisa) চিত্রকর্মটি চুরি হয়ে যাওয়ার পিছনে মিউজিয়ামের একজন কর্মচারী ভিঞ্জ পেরুজিগলাকে দোষী হিসাবে খুঁজে বের করেন।
মোনালিসা চিত্রকর্মটিকে চুরি করার পর ভিঞ্জ পেরুজিগলাকে বেশ কয়েকদিন মোনালিসা (Monalisa) চিত্রকর্মটিকে মিউজিয়ামের একটি বন্ধ ঘরে লুকিয়ে রাখে।
পরে মিউজিয়ম বন্ধ হয়ে গেলে ভিঞ্জ পেরুজিগলা তার কোর্টের তলায় লুকিয়ে,মোনালিসা ছবিটিকে সাথে করে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

ভিঞ্জ পেরুজিগলা ইতালিয় নাগরিক হওয়ার সাথে সাথে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি সর্বদা চাইতেন লিওনার্দো ভিঞ্চির বিখ্যাত মোনালিসা চিত্রকর্মটি,
ভিঞ্চির নিজের দেশ ইতালির কোনো সংগ্রহশালায় থাকা উচিত। মোনালিসা চিত্রকর্ম চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনার ০২ বছর পরে ভিঞ্জ পেরুজিগলা মোনালিসা শিল্পকর্মটিকে
ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের আর্ট মিউজিয়ামের অধক্ষের কাছে বিক্রি করার জন্য নিয়ে যায় এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য মোনালিসা ছবিটিকে ইতালির আর্ট মিউজিয়ামে রেখে দেওয়া হয়।
এই ঘটনার খবর লুবর মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাতে দেরি হয়না। লুবর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ভিঞ্জ পেরুজিগলার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে
ভিঞ্জ পেরুজিগলাকে ০৬ মাসের জেল হয় এবং ১৯১৪ সালের ০৪ জানুয়ারী লুবর মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষ মোনালিসা ছবিটাকে পুনরায় লুবর মিউজিয়ামে স্থাপন করে।
এখন আমাদের প্রশ্ন হল ভিঞ্চি একজন ইতালিয় নাগরিক হয়ে তার সৃষ্ট শিল্পকর্ম মোনালিসা ছবি ইতালি থেকে ফ্রান্সে কি করে এল ?
মোনালিসা ছবির ইতিহাস
মোনালিসা ছবির ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলে দেখতে পাওয়া যায়,১৫১৬ সালে লিওনার্দো ভিঞ্চি ফ্রান্সের রাজার কাছ থেকে ফ্রান্স যাওয়ার নিমন্ত্রণ পান,এরপর ভিঞ্চি তার শিল্পকর্ম মোনালিসাকে সাথে করে
ফ্রান্স চলে আসেন। লিওনার্দো ভিঞ্চির মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারী সূত্রে ভিঞ্চির এক অনুগত শিষ্য সলাই নামের এক শিষ্যের হাতে মোনালিসা চিত্রকর্মটি পৌঁছায়।
পরে ভিঞ্চির শিষ্য সলাই বেশ কয়েক হাজার স্বর্ণ মুদ্রার বিনিময়ে লিওনার্দো ভিঞ্চির মোনালিসা চিত্রকর্মটি ফ্রান্সের রাজার কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর ১৫১৯ সালের পর থেকে ভিঞ্চির আঁকা
মোনালিসা চিত্রটি ফ্রান্সের রাজাদের মালিকানা সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ফ্রান্স রাজাদের রাজত্বের অবসান হলে ১৯১৭ সালে মোনালিসা ছবিটিকে প্যারিসের লুবর মিউজিয়ামে রাখা হয়।
ইতালিয় নাগরিকরা মোনালিসা ছবির ইতিহাস জানার পর ইতালি সরকারের কাছে মোনালিসাকে তাদের দেশের সম্পত্তি হিসাবে ইতালিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার দাবি রাখেন।
বহু ইতালিয় নাগরিকের বিশ্বাস মোনালিসা চিত্রকর্মটি ফ্রান্সের কাছে বিক্রি করা হয়নি,ফ্রান্স আসলে মোনালিসা ছবিটাকে চুরি করে তাদের দেশে নিয়ে গেছে।
মোনালিসা ছবিটির আর একটি হুবহু যমজ ছবি আছে,এই ছবিটি এঁকেছিলেন লিওনার্দো ভিঞ্চির এক শিষ্য ফ্রেন্সিস্কো মেলজি। বর্তমানে মোনালিসার যমজ ছবিটি
স্পেনের রাজধানী মেদ্রিত শহরের পত্রাদি মিউজিয়ামে রাখা আছে। মোনালিসা ছবিটাকে বেশ কয়েকবার ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়েছে।
১৯৫৬ সালে বলিভিয়া তাইরিস নামের একজন ব্যক্তি মোনালিসা ছবিটির উপর পাথর ছুড়ে মারেন,ফলে পাথরের আঘাতে মোনালিসার বাম কনুইয়ের কাছের কিছু অংশের রং চটে যায়।
পরে অবশ্য লুবর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ মোনালিসার কনুইয়ের ক্ষত পুনঃ পেন্টিং করে সারিয়ে দেয়। তবু ভালো ভাবে লখ্য করে দেখলে দেখতে পাওয়া যায় মোনালিসার কনুইয়ে কাছে হালকা ক্ষতের দাগ রয়েই গেছে।
এই ঘটনার বহুদিন আগে মোনালিসার উপর একবার অ্যাসিড এটাক করা হয়েছিল,এইসব ঘটনার পুনঃকরণ দেখে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ মোনালিসার নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেয়।
মোনালিসা ছবিটাকে লুবর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ বুলেট প্রুফ কাঁচ দিয়ে সুরক্ষা কবচে মুড়ে রেখেছেন। ২০০৯ সালে রাশিয়ার একজন মহিলা মোনালিসার উপর চিনামাটির পাত্র দিয়ে
আঘাত করার চেষ্টা করে,কিন্তু মোনালিসা বুলেট প্রুফ কাঁচের মধ্যে সুরক্ষিত থাকায় মোনালিসার সেরকম কোনো ক্ষতি করে উঠতে পারেনি।
লিওনার্দো ভিঞ্চি শুধু একজন বিখ্যাত চিত্রকর ছিলেন না,তিনি একজন সুদক্ষ লেখকও ছিলেন। মোনালিসা ছবির অজানা রহস্য খুঁজতে গিয়ে আমাদের মনে সর্বদা একটা
প্রশ্ন উঁকি মারে,ভিঞ্চি নিজে একজন চিত্রকরের সাথে সাথে একজন বিশিষ্ট লেখক হওয়া সত্ত্বেও তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসাকে নিয়ে তার লেখা কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিদের হাত থেকে মোনালিসা ছবিটিকে বাঁচানোর জন্য মোনালিসা ছবিটির স্থান পরিবর্তন করা হয়। এই সব ঘটনা দেখে আপনারা
মূল্যায়ন করতে পারছেন নিশ্চয়,মোনালিসা চিত্রকর্মের রহস্য এবং মোনালিসা ছবির ইতিহাসের পাতায় ঐতিহাসিক মূল্য তাহলে কতটা ?
মোনালিসা ছবির অজানা রহস্য এবং মোনালিসা ছবির ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে আর একটি জিনিস আমাদের সামনে আসে। লিওনার্দো ভিঞ্চির আর একজন ছাত্র
১৫১৪-১৫১৬ সালের ভিতরে একটি নগ্ন মহিলার ছবি আঁকেন। মতান্তরে লিওনার্দো ভিঞ্চি নিজেই এই নগ্ন ছবিটি এঁকেছিলেন বলে মনে করা হয়।
ভিঞ্চির এই ছবিটিকে মোনাভামা বলা হয়ে থাকে। মোনাভামা এবং মোনালিসা ছবিটির মধ্যে একটি কমন জিনিস লক্ষ করা যায়।
মোনালিসা এবং মোনাভামা দুইজনের হাত রাখার ভঙ্গি কিন্তু একই রকমের। বর্তমানে লিওনার্দো ভিঞ্চির আঁকা অর্ধ নগ্ন মোনাভামা চিত্রকর্মটি ফ্রান্সের ক্যানাভেলেট মিউজিয়ামে রাখা আছে।
আরো পড়ুন : ইন্ডিয়া গেট নির্মাণের ইতিহাস।
মোনালিসা ছবির দাম কত
মোনালিসা ছবির দাম কত ? এই প্রশ্নের একবাক্যে জবাব দেওয়া খুব দুস্কর। তবে মোনালিসা ছবিটির যে ঐতিহাসিক মূল্য আছে সে নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারেনা।
লিওনার্দো ভিঞ্চি মোনালিসা ছবিটি আঁকার জন্য ৩০ এর থেকে বেশি লেয়ারের পেন্টিং টেকনোলজির ব্যবহার করেছিলেন। এর মধ্যে কিছু কিছু রঙের লেয়ার মাথার চুলের থেকেও সুক্ষ ছিল।
গ্রিনিচ বুক ওয়াল্ড রেকর্ড অনুযায়ী মোনালিসা ছবিটি হল পৃথিবীর অন্যতম একটি দামি পেন্টিং এবং বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে আজ পর্যন্ত যত রকমের পেন্টিং আছে তার তুলনায় মোনালিসা সবথেকে দামি পেন্টিং।
আপনাদের প্রশ্ন হল মোনালিসা ছবির দাম কত ? তাহলে মোনালিসা ছবিটির দাম নিয়ে একটা ধারণা আপনাদের দেওয়া যাক।
১৯৬২ সালে মোনালিসা ছবিটির দাম উঠেছিল ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি,আজকে যদি সেই ভাবে মোনালিসা ছবির দাম কত দেখতে চান তাহলে
বর্তমানে মোনালিসা ছবিটির রহস্যময় দাম শুনে আপনার মাথায় বাজ পড়তে পারে। আজকে ২০২১ সালে মোনালিসা ছবির রহস্য জনক দাম হল ৮০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
কিন্তু হতাশজনক হলেও এটা সত্যি ফ্রান্স সরকারের ন্যাশনাল হ্যারিটেজ সংরক্ষণ নিয়ম অনুযায়ী মোনালিসা (Monalisa) কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।
মোনালিসা হল ন্যাশনাল হ্যারিটেজ সংগ্রহশালার একটি অংশ বিশেষ,তাই এই ধরণের সম্পত্তি অর্থের বিনিময়ে হস্তান্তর যোগ্য নয়,মোনালিসা হল সমগ্র বিশ্ববাসীর অমূল্য সম্পদ।
ফ্রান্সের রাজা নেপোলিয়নের মোনালিসা ছবিটি এতটাই প্রিয় ছিল যে,নেপোলিয়ন মোনালিসার ছবিটাকে তার স্বয়নকক্ষের সামনে দেওয়ালে লাগিয়ে রেখেছিলেন।
১৫৩০ সালে ফ্রান্সের এক রাজা মশাই মোনালিসা ছবিটাকে তার বাথরুমের ভিতর টাঙিয়ে রাখেন। ছবিটি দীর্ঘদিন বাথরুমের দেওয়ালে থাকার ফলে ছবিটির কাঠের ফলকে ছত্রাক জমে গেছিল।
সেই জন্য মোনালিসা ছবিটির রং কিছুটা ফিকে পরে গেছে বলে মনে করা হয়। মোনালিসা ছবিটাকে সাধারণ ভাবে আপনারা হয়ত অনেক বড় আকারের পেন্টিং বলে মনে করে থাকেন।
কিন্তু আপনাদের এই ধারণা কিন্তু একেবারে ভুল। মোনালিসা ছবিটা কিন্তু আসলে এতটা বড় নয়। ফ্রেম বন্দি মোনালিসার দৈর্ঘ্য হল ৩০ ইঞ্চি এবং প্রস্থ হল ২১ ইঞ্চি মাত্র।

লিওনার্দো ভিঞ্চি মোনালিসা ছবিটাকে কোনো কাগজের উপর পেন্টিং করেননি,মোনালিসাকে তিনি পেন্টিং করেছিলেন একটি কাঠের ফলকের উপর।
এই কাঠের ফ্রেম বন্দি মোনালিসা ছবিটির মোট ওজন প্রায় ০৮ কেজির কাছাকাছি। ভিঞ্চি মোনালিসা ছবিটাকে এতটাই নিখুঁত ভাবে এঁকেছিলেন যে ছবির মধ্যে তুলির একটি দাগ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় না।
আরো একটি মোনালিসা ছবির অজানা রহস্য জেনে আপনারা হয়ত অবাক হবেন,মোনালিসা ছবিটি আঁকার জন্য লিওনার্দো ভিঞ্চি Strmato technic ব্যবহার করেছিলেন।
এই Strmato technic দ্বারা একটি রঙের সঙ্গে আর একটি রঙের এমনভাবে মিশ্রণ করা হয় যে তাতে পেন্টিংয়ের উপর তুলির আঁচড় অথবা ছবির উপর কোনো আউট লাইন দেখতে পাওয়া যায় না।
মোনালিসা ছবিটির পিছনের দৃশ্যপট আঁকার জন্য ভিঞ্চি ব্লার টেকনিকের প্রয়োগ করেন। আর এই টেকনিকের জন্য মোনালিসা ছবিটাকে ফ্রেমের মধ্যে জীবন্ত বলে মনে হয়।
আরো পড়ুন : বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর রহস্য।
মোনালিসা ছবির রহস্য
মোনালিসা ছবির রহস্যর অন্ত নেই। লিওনার্দো ভিঞ্চি মোনালিসা ছবিটার উপর সবমিলিয়ে ১৬ বছর কাজ করেন। এই ঘটনা থেকে ভিঞ্চির ধৈর্য্য এবং সুক্ষ
মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সাধারণ ভাবে মানুষ কাজ পাগল না হলে এমন অসীম ধৈর্য্য শক্তি রাখতে পারেনা। ভিঞ্চি টানা ১৬ বছর ধরে মোনালিসা ছবিটার উপর কাজ করেও
তার মনে হয়েছিল তিনি মোনালিসা ছবিটার পুরো কাজ এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেননি। মোনালিসা ছবিটাকে আপনি ভালো করে অধ্যয়ন করলে মোনালিসা ছবির রহস্যময়
আশ্চর্য়্য় সব জিনিস আপনার চোখে পড়বে। মোনালিসার ছবিতে ভালো করে চেয়ে দেখলে দেখতে পাবেন মোনালিসার চোখের পাতা এবং ভ্রু চোখে পড়েনা।
এইসব জিনিস মোনালিসা ছবির রহস্যকে আরো বাড়িয়ে তোলে। আপনি ভেবে দেখুন মোনালিসা ছবিটাকে ভিঞ্চি ১৬ বছর ধরে অসীম ধৈর্য্য নিয়ে এঁকেছিলেন,
তাহলে তিনি মোনালিসার ভ্রু না আঁকার মত ভুল কাজ কিভাবে করতে পারেন ? মোনালিসার ভ্রু যুগল না থাকার জন্য অনেকে মনে করেন মোনালিসা ছিলেন একজন পতিতা মহিলা।
কারণ তখনকার দিনে গ্রীক সংস্কৃতিতে বেশ্যাবৃত্তি করা পতিতা মহিলারা নিজেদের ভ্রু সেভিং করতেন। বেশ্যা মহিলাদের ভ্রু না রাখার এক প্যাশান ছিল গ্রীক সংস্কৃতিতে।
২০১৭ সালে ফ্রান্সের ফটোগ্রাফি বিশেষজ্ঞ প্যাসকেল কোর্ট হাইরেজুলেশন ক্যামেরার দ্বারা মোনালিসা (Monalisa) ছবিটাকে স্ক্যান করে এক নতুন তত্ব সামনে নিয়ে আসেন।
প্যাসকেল কোর্ট এর মতে ভিঞ্চি যখন মোনালিসা চিত্রটি এঁকেছিলেন তখন তিনি মোনালিসার ভ্রু এবং মোনালিসার চোখের পাতা দুইই ছিল।
ভিঞ্চি খুব সুক্ষ ভাবে মোনালিসার ভ্রু এবং চোখের পাতা এঁকেছিলেন। পরবর্তীকালে সময় বিশেষে মোনালিসার ছবি পরিষ্কার করা হতে থাকলে মোনালিসার ভ্রু এবং চোখের পাতা ধীরে ধীরে মিটিয়ে যায়।
১৯৬৩ সালে ফ্রান্সের সরকার দ্বারা মোনালিসা ছবিটাকে দুই মাসের জন্যে আমেরিকার মিউজিয়ামে প্রদর্শনীর জন্য পাঠানো হয়। মোনালিসা ছবিটাকে প্রথমে U.S National Galrey of Arts
এবং নিউয়র্কের Metropolitan Museum of Art গ্যালারিতে ০৩ সপ্তাহের জন্য প্রদর্শন করা হয়। আপনারা জানলে অবাক হবেন সেই সময় মোনালিসা ছবিটাকে
এক ঝলক দেখার জন্যে দর্শকদের ০২ ঘন্টা ধরে লাইনে অপেক্ষা করার পর,শুধু ২০ সেকেন্ডের জন্য মোনালিসাকে (Monalisa) দেখার সুযোগ পেত।
জনৈক এক ইউরোপের ওয়েব সাইট দ্বারা দাবি করা হয়, মোনালিসা ছবির বাম পাশে আয়না ধরলে মোনালিসার ছবি আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে মোনালিসার কাঁধের বাম পাশে একটি এলিয়নের মুখ দেখতে পাওয়া যায়।
এই ধরণের গল্প কথা মোনালিসা ছবির রহস্য আরও একবার বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেয়,যখন মোনালিসাকে নিয়ে আরও একটি নতুন তত্ত্ব সামনে আসে-
বিশেষজ্ঞ দল যখন মোনালিসাকে খুব কাছ থেকে অতি সুখানুসূক্ষ ভাবে অধ্যয়ন করছিলেন তখন মোনালিসার পশ্চাদ প্রেক্ষাপটে একটি ইতালীয় ভাষায় লেখা বাক্য দেখতে পায়।
ইতালিয় ভাষায় যে বাক্য লেখা ছিল তা হল –La-Risposta-Si, যার বাংলা মানে হল উত্তর এখানে আছে। ২০০৩ সালে আমেরিকার একজন সাহিত্যিক The Vinchi Code নামের একটি উপন্যাস লেখেন।
আর এই উপন্যাসের ভিত্তিতে একটি হলিউড সিনেমা তৈরি হয় সিনেমায় ভিঞ্চির এই সিক্রেট কোডকে নিয়ে একটি রহস্য ও রোমাঞ্চ মূলক সিনেমা প্রস্তুত করা হয়। ২০১০ সালে ইতালিয়ান একজন ঐতিহাসিক
সিলভানো ভিনেক্টি,যিনি পেশায় একজন শিল্পী ছিলেন,তিনি মোনালিসা ছবির উপর এক নতুন তত্ত্ব নিয়ে আসেন। তাঁর মতে ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা ছবির বাম চোখের মনির ভেতর খুব ছোট অক্ষরে০২ টা
ইংরেজি বর্ণ লেখা আছে। এই বর্ণ ০২ টি হল L&V যার অর্থ হল Leonardo-da-Vinchi,এবং মোনালিসার ডান চোখের মনির মধ্যে লেখা আছে C&B, যার অর্থ আজও উদ্ধার করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
আরো পড়ুন : কালাপানি সেলুলার জেলের ইতিহাস।
FAQ
প্রশ্ন: মোনালিসা ছবিটি কার আঁকা ?
উঃ – মোনালিসা ছবিটি ইতালীয় চিত্রকর লিওনার্দো ভিঞ্চির আঁকা।
প্রশ্ন : মোনালিসা ছবিটি আঁকতে কত সময় লেগেছিল ?
উঃ- মোনালিসা ছবিটি আঁকতে লিওনার্দো ভিঞ্চির ১৬ বছর সময় লেগেছিল।
প্রশ্ন : মোনালিসা কে ?
উঃ- মোনালিসা হল লিওনার্দো ভিঞ্চির একটি বিশ্ব বিখ্যাত চিত্রকর্ম।
প্রশ্ন : মোনালিসা ছবির দাম কত ?
উঃ – মোনালিসা ছবির দাম প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার।
প্রশ্ন : মোনালিসা ছবি কোন মিউজিয়ামে আছে ?
উঃ – মোনালিসা ছবিটি প্যারিসের লুবর মিউজিয়ামে রাখা আছে।