করবা চৌথ কেন পালন করা হয় (Korba Chouth keno Palon Kora Hoy)

হিন্দু সধবা মহিলাদের ১২ মাসে ১৩ পার্বণের তালিকায় বিভিন্ন ধরণের পূজা ও উৎসব রয়েছে, তার মধ্যে করবা চৌথ ব্রত হল অন্যতম। তবে করবা চৌথ কি শুধু উত্তর ভারতের হিন্দু সধবা নারীর পূজা ?

না ভারতের অন্যান্য জায়গায় হিন্দু নারীরাও করবা চৌথ ব্রত পালন করেন। যদিও বাঙালি সংস্কৃতিতে করবা চৌথ ব্রতর প্রচলন সেরকমভাবে না থাকলেও

উত্তর ভারতের সধবা নারীরাদের মধ্যে ধুম ধাম করে করবা চৌথ ব্রত পালন করার রীতি দেখতে পাওয়া যায়। তাই অনেকে করবা চৌথকে উত্তর ভারতের নারীদের মূল ব্রত বলে থাকে।

আজকের আর্টিকেলে আমরা করবা চৌথ কি, করবা চৌথ ব্রত কবে,করবা চৌথ কেন পালন করা হয়,করবা চৌথ পূজা বিধি,করবা চৌথ ব্রত কথা সমন্ধে জানব।

করবা চৌথ কি (Karba Chouth Ki)

করবা চৌথ ব্রত হল হিন্দু সধবা স্ত্রীদের অন্যতম আভূষণ ব্রত,তাই করবা চৌথ ব্রত সাধারণত বিবাহিত সধবা মহিলাদের দ্বারা উদযাপন করা হয়। হিন্দু পরম্পরা অনুযায়ী করবা চৌথ ব্রতর মধ্যে দিয়ে বিবাহিত মহিলারা

তার স্বামীর দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনায় করবা চৌথের নির্জলা উপবাস রাখে। আজকাল অনেক অবিবাহিত তরুণীরা তাদের মনপুত স্বামী পাওয়ার জন্যে করবা চৌথ ব্রত পালন করে থাকেন।

করবা চৌথ কবে (Korba Chouth Kobe )

২০২২ সালে করবা চৌথ ব্রত ১৩ অক্টবর বৃহস্পতি বার উদযাপন করা হবে।

করবা চৌথ ব্রতর সময়সূচী ২০২২ (karba Chouth Broto 2022)

করবা চৌথ ব্রত কবে ২০২২করবা চৌথ ব্রত ১৩ অক্টবর বৃহস্পতি বার ,২০২২
করবা চৌথ কোন তিথিতে উদযাপন করা হয় করবা চৌথ ব্রত কার্তিক মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্থীর দিন উদযাপন করা হয়
করবা চৌথ ব্রততে কোন ভগবানের পূজা করা হয়/ কার পূজা করা হয় ভগবান শিব,মাতা পার্বতী,কার্তিক এবং গণেশের পূজা করা হয়
করবা চৌথ ব্রতর সময়সূচী ১৩ অক্টবর ২০২২ রাত্রি ০১ টা ৫৯ মিনিট থেকে ১৪ অক্টবর ভোর ০৩ টা ০৮ পর্যন্ত
করবা চৌথ কি

করবা চৌথ ব্রত কেন পালন করা হয়

‘করবা চৌথ’ শব্দটি তৈরী হয়েছে করবা এবং চৌথ এই দুটি শব্দের মেল বন্ধনে। করবা শব্দের বাংলা মানে হল কড়াই এবং চৌথ শব্দটির বাংলা মানে দাঁড়ায় চতুর্থী

করবা চৌথের আগের দিন শাশুড়ির মায়ের হাতে বানানো খাবার খেয়ে খেয়ে বাড়ির বৌমা তার স্বামীর দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনায় নির্জলা উপবাস ব্রত রাখেন।

করবা চৌথ কি
করবা চৌথ কি

তারপর সন্ধে বেলা চাঁদ এবং স্বামীর মুখ চালুনের মধ্যে দিয়ে দেখে করবা চৌথের উপবাস ভঙ্গ করা হয়। মূলত বিবাহিত সধবা মহিলারা স্বামীদের দীর্ঘায়ুর জন্যে করবা চৌথের ব্রত রাখেন।

আবার করবা চৌথের সঙ্গে কৃষি কাজ কর্ম জড়িয়ে আছে,এই সময় খেতে পুরোনো ফসল কেটে নতুন ফসল বোনা হয়,তাই করবা চৌথের কড়ায়ের মধ্যে গমের দানা রেখে ভগবানকে উৎসর্গ করা হয়।

করবা চৌথ পূজার বিধি নিয়ম

করবা চৌথ পূজার কিছু বিধি নিয়ম আছে,আসুন আমরা করবা চৌথ পূজার বিধি নিয়ম গুলো নিয়ে একটু জানার চেষ্টা করি। করবা চৌথ ব্রত পূজা করার জন্যে সবার প্রথমে একটি বড় মাপের পুষ্প পরতের উপর

জল ভর্তি ঘট এবং একটি কড়ায়ের মধ্যে গম ভর্তি করে রাখা হয়। করবা চৌথের পূজা করার জন্যে বাড়ির ঠাকুর ঘরের দেওয়ালে কাগজ বসিয়ে,সেই কাগজের উপর ভগবান শিব এবং কার্তিকের পট ছবি আঁকা হয়।

করবা চৌথের দিন করবা চৌথ ব্রত রাখা মহিলারা পুরো নির্জলা উপবাস রাখার পর সন্ধেবেলা ভগবান শিব এবং কার্তিক ভগবানের পট ছবির পূজা করেন।

তারপর রাতের আকাশে চাঁদ দেখা দিলে ভগবান চন্দ্র দেবকে অর্ঘ্য নিবেদন ও আরতি করার পর, করবা চৌথ ব্রত সম্পন্ন হয়। তারপর করবা চৌথ ব্রতী মহিলারা চালুন দিয়ে চাঁদ এবং স্বামীর মুখ দেখে।

এইভাবেই করবা চৌথ পূজা বিধি সম্পন্ন হওয়ার পর উপবাসি মহিলারা রাত্রে জল গ্রহণ করে তাদের উপবাস ভঙ্গ করেন। তবে নিয়ম মাফিক কোনো সধবা স্ত্রী একবার ব্রত রাখলে সেই মহিলাকে আমরণ করবা চৌথ ব্রত রাখতে হয়।

করবা চৌথ ব্রত কথা

প্রবাসে যুদ্ধ ক্ষেত্রে থাকা সৈনিক স্বামীদের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনায় সৈনিকদের স্ত্রীরা এক ধরণের বিশেষ ব্রত রাখতো, সৈনিকদের স্ত্রীর রাখা ব্রতকেই করবা চৌথ ব্রতবলা হয়।

সৈনিক স্বামীরা যুদ্ধের ময়দানে থাকায় সৈনিকের স্ত্রীরা চিন্তায় প্রহর গুনতো, তাই সৈনিকের স্ত্রীরা,কার্তিক মাসের চতুর্থীর দিন উপোস রেখে পূর্ণ্য চন্দ্র দেখা দিলে প্রবাসে থাকা স্বামীর মুখকে চাঁদের মধ্যে কল্পনায় দেখে তাদের উপবাস ভঙ্গ করে করবা চৌথ ব্রত পালন করত।

তবে পুরাণের কাহিনীতে করবা চৌথ নিয়ে খুব সুন্দর একটি কাহিনী আছে,আসুন আমরা করবা চৌথের সেই কাহিনী শুনি –

একসময়ে ইন্দ্রপ্রস্থ পুর নামে এক নগরে, বেদ শর্মা নামের এক গরিব ব্রাহ্মণ বাস করতেন। বেদ শর্মার ০৭ ছেলে ও বিরাবতী নামে একটি অতি সুন্দরী মেয়ে ছিল।

০৭ ভাইয়ের মাঝে একটি মাত্র বোন থাকায়, বোন বিরাবতী ভাইদের কাছে ছিল অতি আদরের বোন। পরে কিশোর পেরিয়ে যৌবন এলে সৎ ব্রাহ্মণ ছেলের সঙ্গে বিরাবতীর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।

বিরাবতী বিয়ের পর বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন এবং করবা চৌথের দিন, বিয়ের পর প্রথমবার স্বামীর মঙ্গলকামনায় করবা চৌথ ব্রত করেন।

কিন্ত বিরাবতী সকাল গড়িয়ে,দুপর হয়ে,সন্ধে নামার আগেই ক্ষুধা,তৃষ্ণা সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়। এদিকে বিরাবতীর ভাইয়েরা বোনের কষ্ট দেখে সন্ধে নামতেই চাঁদ বেরোনোর আগেই,

বাড়ির প্রাচীরের কোনে থাকা অশ্বথ গাছের উপর চালুনের আড়ালে প্রদীপ রেখে, বোন বিরাবতীকে প্রদীপের আলোকে চালুনির মধ্যে দিয়েই চাঁদ হিসাবে দেখায়।

বিরাবতী তখন স্বামীর মঙ্গল কামনায় করা করবা চৌথের উপবাস ভেঙে অন্ন জল গ্রহণ করতে বসেন। খাবার খেতে বসেই প্রথম গ্রাস মুখে ঢোকাতে গেলেই অন্নের মধ্যে চুল পায় ,

তাই প্রথম গ্রাসের অন্ন রেখে, দ্বিতীয় গ্রাস খেতে গেলে হাঁচি পড়ে। আবার তৃতীয় গ্রাস খেতে গেলে শশুর বাড়ির লোকেদের কাছে স্বামীর মৃত্যুর খবর পায়।

স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে বিরাবতী শশুরবাড়ি চলে যায়, সেখানে মৃত স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে। বিরাবতীর কান্না দেখে দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী ছুটে এসে বিরাবতীকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

ইন্দ্র দেবের পত্নী বিরাবতীর করবা চৌথ ব্রতে করা ভুল গুলো ধরিয়ে দেন এবং বিরাবতীকে পুরো বছর করবা চতুর্থীর উপবাস রেখে করবা চৌথের দিন নির্জলা করবা চৌথ ব্রত রাখার পরামর্শ দেন।

এরপর বিরাবতী তার কর্মগুণে করবা চৌথের ব্রত দ্বারা স্বামীর জীবন ফিরে পায়। তারপর থেকে বিশ্বাসমতে স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় সধবা মহিলারা প্রতিবছর কার্তিক মাসের চতুর্থীর দিন করবা চৌথ পালন করে থাকেন।

করবা চৌথ উদযাপন

করবা চৌথের আগের দিন অথাৎ কার্তিক মাসের চুতুর্থীর আগের দিন রাত্রি বেলা, বৌমারা শাশুড়ি মায়ের হাতে বানানোর খাবার খান,পরের দিন সকাল বেলা স্নান করে যিনি করবা চৌথ রাখবেন,

সেই ব্রতী মহিলা ঠাকুর ঘরে ভগবান শিব,পার্বতীর পট চিত্রের সামনে ভক্তি ভরে পূজা করে, করবা চৌথ ব্রত রাখার জন্যে সংকল্প নেন। তারপর পুরোটা দিন ব্রত করা মহিলা অন্নজল গ্রহণ না করে সম্পুর্ণ নির্জলা উপবাস রাখেন।

এরপর পুরো দিন গড়িয়ে সন্ধে বেলা ঠাকুর ঘরে আঁকা শিব,পার্বতী,কার্তিক ও গণেশের পট ছবির পূজা করে স্বামীর দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনা করেন।

তারপর একটি বড় তামার থালা বা পুষ্প পরতের উপর ঘট ভর্তি গঙ্গা জল, একটি ছোট কড়াইয়ের মধ্যে গমের দানা এবং সিঁদুর,টিপ,চন্দন,বিউলি ডাল,চালুনি ও প্রদীপ রাখা হয়।

করবা চৌথ কি
করবা চৌথ কি

তারপর তামার পুষ্প পরতটি শাশুড়ি মায়ের হাতে দিয়ে শ্বাশুড়ি মাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেওয়া হয়। এরপর সন্ধেবেলা আকাশে চাঁদ দেখা দিলে, খোলা আকাশের নিচে

চাঁদকে চালুনির মধ্যে দিয়ে দেখার পর চাঁদকে প্রণাম করে চন্দ্র দেবতার উদ্দ্যশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করে আরতি করা হয়। তারপর স্বামীর মুখ চালুনির মধ্যে দিয়ে দেখতে হয়।

এইসব কিছু হয়ে যাওয়ার পর স্বামীর কপালে চন্দনের তিলক পড়িয়ে দেওয়া হয়,একইভাবে স্বামী স্ত্রীর সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে দেয় তারপর স্ত্রী স্বামীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়।

স্বামী স্ত্রীকে আশীর্বাদ করার পর নিজের হাতে গ্লাস দিয়ে জল পান করিয়ে স্ত্রীর করবা চৌথ ব্রতর উপবাস ভঙ্গ করে। এইভাবেই করবা চৌথ ব্রত উদযাপন করা হয়।

করবা চৌথের দিন স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের সুন্দর উপহার দেয়,এছাড়া সেদিন ঘরে লুচি,সুজির হালুয়া তৈরী করা হয়। সামর্থ্য ব্যক্তিরা যারা পারেন তারা ১৩ জন ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান এবং দক্ষিনা দেন।

করবা চৌথের সাজগোজ

করবা চৌথের দিন সন্ধে বেলা ব্রতী মহিলারা নতুন লাল,হলুদ,গোলাপি রঙের শাড়ি পড়েন। দুই হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে,দুই হাত ভরে কাঁচের চুড়ি,সিঁথিতে সিঁদুর এবং কপালে লাল রঙের টিপ পড়েন।

এছাড়া গলায় মঙ্গল সূত্র,পায়ে আলতা,নুপুর ও আরো অন্যন্য গয়না পড়েন। তবে করবা চৌথের দিন,কালো,বেগুনি,নীল ইত্যাদি রঙ গুলোকে অশুভ মনে করা হয়,তাই সেদিন এই রঙ গুলো থেকে ব্রতী মহিলারা দূরে থাকেন।

করবা চৌথ ভজন

করবা চৌথের ভজন শোনার জন্য নিচের বটনে ক্লিক করুন।

করবা চৌথ

পরিশিষ্ট

সভ্যতা ও সংস্কৃতির দেশ ভারতবর্ষে হিন্দুদের প্রতিটি উৎসবে জড়িত রয়েছে আস্থা,ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। করবা চৌথ ব্রতর মাধ্যমে পতিব্রতা স্ত্রীরা উপবাস রেখে স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে এই নয়,

এই ব্রতর মাধ্যমেই ভক্তরা ভগবানের আরো কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়। করবা চৌথের ব্রত আজ শুধু পশ্চিম ভারতের নারীদের মধ্যেই সীমিত নেই,

আজকাল ভারতের সমস্ত নারীরা করবা চৌথ ব্রত রেখে স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করেন। তাই উৎসবে শুধু আমাদের জীবনে সুখদায়ক আনন্দ নিয়ে আসেনা,উৎসব আমাদের ভগবানের প্রতি আস্থা,বিশ্বাস,সংকল্প ও ভালোবাসা জাগায়।

FAQ

প্রশ্ন – করবা চৌথ কবে ?

উঃ- করবা চৌথ ২০২২ সালের ১৩ অক্টবর বৃহস্পতি বার।

প্রশ্ন – করবা চৌথে কার পূজা করা হয় ?

উঃ – করবা চৌথে ভগবান শিব,পার্বতী,কার্তিক ও গণেশের পূজা করা হয়।

প্রশ্ন – করবা চৌথ কেন করা হয় ?

উঃ- করবা চৌথ পতিব্রতা স্ত্রীরা স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনার জন্যে করা হয়।

আমাদের আর্টিকেলটি ভালো লাগলে ০৫ ষ্টার রেটিং দিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here